প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা সবাই মুগ্ধ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায়না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, আর পাহাড় ও ঝর্ণা যেন একসাথে প্রকৃতিকে আরো অনেক বেশি সুন্দর করে দিয়েছে। পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণা যখন পতিত হয়, সেই মনমুগ্ধকর শব্দ সবারই প্রাণে ধরে। আর ঝর্ণায় এসে কার না মন প্রফুল্ল হয়ে থাকে। আজ আমি কথা বলবো মিরসরাই এর খৈয়াছড়া ঝর্ণা নিয়ে। এই অপরূপ ঝর্ণাটি বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে থাকে কেননা পানি অনেক বেশি থাকে। তবে দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি তাই বর্ষাকাল সাবধানে থাকবেন। বর্ষাকালে প্রতিটি ঝর্ণার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। একটু বেশি সৌন্দর্য পেতে চাইলে একটু তো ঝুঁকি নিতে হবে।
তাহলে শুরু করা যাক একদিনের ছোট্ট ভ্রমণ কাহিনী।
খৈয়াছড়া ঝর্ণাকে অনেক সময় মৃত্যুকূপ ও বলে থাকে, কেননা ৭ টি স্তর এ উপরের স্তরে যাওয়ার জন্য অনেক ঝুঁকি নিতে হবে। প্রচুর সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তা না হলে দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে যেকোন সময়। তাহলে চলুন শুরু করি।
আমরা ভাইয়ারা মিলে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যাবার জন্য বের হলাম সকাল বেলা। খৈয়াছড়া ঘুরে দেখতে চাইলে আপনাকে পুরো একটি দিন সময় দিতে হবে। যেহেতু ঝর্ণায় ট্রেইল রয়েছে তাই আপনারা চাইলে ট্রেইল করার উপযোগী জুতো নিয়ে যেতে পারেন, আর সাথে কিছু হেলথ কিট রাখবেন। ঝর্ণার পানি পড়ে মোবাইল, ক্যামরা যেন ভিজে না যায় সেজন্য প্লাস্টিক এর ব্যাগ বা পলিথিন নিয়ে যেতে পারেন। ঝর্ণায় যখন যাবেন তখন ভিজতে তো হবে, তাই অতিরিক্ত কাপড় নিতে ভুলবেন না। আর সাথে লাঠি অবশ্যই নিবেন, চলার পথে সাহায্য করবে অনেক।
কিভাবে যাবেনঃ
ঢাকা টু খৈয়াছড়া ঝর্ণা
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী বাস আপনাকে মিরসরাইয়ের বাজার এর একটু আগে নামিয়ে দিতে বললে নামিয়া দিবে । ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী বাস যেমন সৌদিয়া, এনা অথবা শ্যামলী করে আসা যাবে। ভাড়া ২৭০-৩৮০ টাকার মধ্যে হবে । সিডিএম অথবা BRTC এর কিছু গাড়ী পেতে পারেন তাতে কিছু খরচ কম পড়বে।
গুগল ম্যাপে সায়েদাবাদ থেকে খৈয়াছড়া ঝর্ণার রোডের মাথা পর্যন্ত লোকেশন দেয়া আছে।
https://goo.gl/maps/oxZDF8xCZR78TYUL6
চট্টগ্রাম টু খৈয়াছড়া
চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা অথবা ঢাকাগামী যেকোনো বাসে উঠলেই আপনাকে খৈয়াছড়া ঝর্ণার রোডের মাথা অথবা বড়তাকিয়া বাজার নামিয়ে দিবে। চট্টগ্রামের একে. খান থেকে তিশা প্লাস অথবা সৌদিয়া করে কুমিল্লাগামী বাসে উঠে পড়বেন আর মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজার নামিয়ে দিতে বললে নামিয়ে দিবে। ভাড়া সৌদিয়াতে ১৫০ নিতে পারে , আর তিশা প্লাস এ ১০০ টাকা নিবে। আরো সিডিএম, চয়েস এর কিছু গাড়ি রয়েছে সেগুলো করে আসতে পারেন, ভাড়া ৮০-১০০ এর মধ্যে হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম থেকে দেড় ঘন্টার মত সময় লাগবে বড়তাকিয়া বাজার পৌঁছাতে। সামান্য হেটে খৈয়াছড়া ঝর্ণার রোডের মাথায় যেতে পারবেন। এর পর রাস্তা পার হয়ে কিছু CNG দেখতে পাবেন সেগুলো করে খৈয়াছড়া ট্রেইল এর আগে পর্যন্ত যেতে পারবেন। ভাড়া ১৫-২০ নিতে পারে জনপ্রতি (২০১৮)।
গুগল ম্যাপে একে খান থেকে খৈয়াছড়া ঝর্ণার রোডের মাথা বাজার পর্যন্ত লোকেশন দেয়া আছে।
https://goo.gl/maps/uysK8ZnrRVzxxrik7
ভ্রমণঃ
সকাল ৯-১০ টার দিকে আমরা বড়তাকিয়া বাজারে নামলাম। তারপর সামনে একটু হেঁটে আমরা খৈয়াছড়া ঝর্ণার রাস্তার মাথায় গিয়ে গাড়ি করে অনেকটুকু গেলাম আর সেখান থেকে ট্রেইল শুরু।
ট্রেইল হাঁটার সুবিধার জন্য আপনারা চাইলে লাঠি নিতে পারেন । তারপর আমরা ট্রেইল ধরে হাঁটা শুরু করলাম ।
যাওয়ার সময় বড়তাকিয়া বাজার থেকে আপনারা চাইলে শুকনো খাবার নিতে পারেন। খৈয়াছড়া এর ট্রেইলে হাঁটা কিছুটা কষ্টকর, তাই সাবধানে হাঁটবেন। কিছু সময় পানিতে কিছু সময় পাহাড়ের পাদদেশ ধরে হাঁটতে হবে। ট্রেইল এর বড় বড় পাথর , অনেক সময় পিচ্ছিল হয়ে থাকে তাই সাবধানে হাঁটতে শুরু করলাম। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে যখন হাঁটছি তখন মানুষের পায়ের পানিতে অনেক বেশই পিচ্ছিল ছিল , তখন লাঠিই ছিল শেষ ভরসা।
![](https://bengalsociety.org/wp-content/uploads/2020/12/image.png)
যাওয়ার পথে কাঠের একটা ব্রিজ ছিল যেটার ছবি নিচে দিলাম।
![](https://bengalsociety.org/wp-content/uploads/2020/12/image-2.png)
ট্রেইল এর চলার পথে দেখতে পাবেন অনে কতগুলো ছোট ছোট গর্ত এর মত যেখানে পানি জমে রয়েছে, মাঝে মাঝে গভীরতা ও বেশি হয়ে থাকতে পারে অথবা পাথর এর খাঁজ থাকতে পারে, তাতে পা পড়লে আটকে যেতে পারে ।
![](https://bengalsociety.org/wp-content/uploads/2020/12/image-4.png)
ঝর্ণার ট্রেইল আমার কাছে অনেক ভালো লাগার গুলোর মধ্যে একটি, কেননা ঝর্ণার শব্দ, পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে যায় পাহাড়ী পরিবেশ এর সাথে, আর যদি ট্রেইলে মানুষ কম থাকে তাহলে তো আর কথাই নাই। ট্রেইল এর সৌন্দর্য টুকু নিতে নিতে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত ঝর্ণায়।
![](https://bengalsociety.org/wp-content/uploads/2020/12/image-6.png)
অনেক বড় একটা ঝর্ণা। পানির এত গতি সরাসরি ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। নিচের ঝর্ণায় অনেক মানুষ থাকে কেননা তুলনা মূলক যাওয়াটা সহজ। বেশির ভাগ সময় নিচের ঝর্ণায় ছবি তুলতে লাইন ধরতে হয়। আমরা তাই সময় নষ্ট না করে উপরের ধাপে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। আমরা যেতে যেতে অনেকেই উপরে গিয়েছে, যার ফলে মাটি আর পানির সংমিশ্রনে দড়িটি এত টা পিচ্ছিল , মনে হচ্ছে এই বুঝি হাত ফসকে পড়ে যাবো! দড়ি শেষ হওয়ার পর আরেকটি উঁচু পথ আছে সেটাতে কোন দড়ি ছিল না । আমার সাহস টুকু একাবারেই শূণ্যের পথে। কোন মত সাহায্য নিয়ে আমি উপরে উঠলাম। উপর থেকে নিচের পর্যটকদের দেখতে ভালোই লাগে!
উপরে ধাপে একসাথে তিনটি স্তর একসাথে দেখতে পারবেন। একসাথে দেখতে অসাধারণ লাগে। একেই নিয়মে ৩ টি স্তর এই পানি পড়তে থাকে।
![](https://bengalsociety.org/wp-content/uploads/2020/12/image-7.png)
পাশ দিয়ে উপরে উঠে গেলাম প্রতিটি স্তরের পানি স্পর্শ করে। এরপরের ধাপ গুলোতে উঠতে তেমন রিস্ক নিতে হয় না । তাই সহজে উঠে গেলাম আমরা।
![](https://bengalsociety.org/wp-content/uploads/2020/12/image-9.png)
এই দুই ধাপ উঠে আমরা আর উপরের দিকে উঠিনি। আপনারা চাইলে ৭ টা স্টেপের প্রতিটি তে আপনারা যেতে পারবেন ।
আমরা ফিরে যাওয়া শুরু করলাম। একেই ভাবে কিন্তু জামেলাটা বাঁধলো শেষের ধাপ নামতে গিয়ে। সাহস হারিয়ে একবারে বাজে অবস্থা, মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাচ্ছি। এইভাবে করতে অনেক কষ্টে নামতে পারলাম। নিচের সবচেয়ে বড় ঝর্ণায় অনেক সময় কাটিয়ে ঠিক বিকেলে ফিরে আসতে শুরু করলাম। যাওয়া টা যত দ্রুত যেতে পেরেছিলাম আসা টা ঠিক তেমন টি হয় নি, আসতে সময় লেগেছে অনেক বেশি, বিশ্রাম নিয়ে শুকনো খাবার খেয়ে চলে আসলাম ।
ঝর্ণার কথা ভাবতে গিয়েও আমার আবেগ কাজ করে। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনের একটা সময় কাটিয়ে দিই ঝর্ণার মনমুগ্ধকর শব্দের কলকলানি শুনতে শুনতে। স্মৃতির পাতায় আটকে থাকুক ভ্রমন জগতের সময় গুলো।
সবাই চলে আসলাম বড়তাকিয়া বাজারে, আর সেখান থেকে গাড়ি থামিয়ে আপনারা ঢাকার উদ্দেশ্য দিতে পারেন অথবা যে কোন গাড়ি করে ফেনী চলে গিয়ে, ফেনী হতে ঢাকায় রওনা দিতে পারেন। আর হাইওয়ে এই পাশে অপেক্ষা করলে চট্টগ্রামগামী অনেকগুলো বাস দেখতে পাবেন, সেগুলো করে আপনাকে সহজে চট্টগ্রামে একে খান মোড় নামিয়ে দিবে।এই ছিল একদিনের ট্যুর। আর হ্যাঁ মনে রাখবেন যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা হতে বিরত থাকুন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবাই রক্ষা করবেন।
ধন্যবাদ সবাইকে।
লিখেছেন,
ইসমাইল আহমেদ ফরহাদ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়