চীনঃ সুমাইয়া আলম চৌধুরী

চৈনিক সভ্যতা থেকে বর্তমান চীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি। উত্তরপূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে জনসংখ্যা বহুল রাষ্ট্র চীন। খ্রিষ্টপূর্ব ২১শতক থেকে চীনে রাজবংশ ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। এর প্রায় ৪০০০ বছর পর ১৯১২ সালে চীনে রাজবংশের বিলুপ্তি ঘটে। ১৬৪৪ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত চিং রাজবংশ চীনের শাসনকার্য পরিচালনা করে। ১লা জানুয়ারি, ১৯১২ সালে চীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সান-ইয়াৎ সেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চীনের জাতীয়তাবাদী দল বা কুওমিনতাং এর নেতা ছিলেন৷ ১৯২৫ সালে সান-ইয়াৎ সেন এর মৃত্যুর পর চিয়াং কাই শেক কুওমিনতাং দলের নেতৃত্ব দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জাপানের আক্রমণে প্রায় ২০ মিলিয়নেরও বেশি চাইনিজ নিহত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চীন প্রজাতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একসাথে অংশগ্রহণ করে। ১লা অক্টোবর, ১৯৪৯ সালে মাও সেতুং এর নেতৃত্বে চীন কে গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। চীনের একমাত্র রাজনৈতিক দল ‘চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি’, মাও সেতুং প্রতিষ্ঠিত এ দলটি ১ অক্টোবর, ১৯৪৯ সাল থেকে চীনের শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে৷ ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে কুওমিনতাং ও চীন প্রজাতন্ত্রের সমর্থকগোষ্ঠি তাইওয়ানে প্রস্থান করেন এবং তাইওয়ান এর শাসনকার্য দখলে নেন। তাইওয়ান বর্তমানে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রভাবে এ রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা সীমিত। ১৯৬৬ সাল থেকে মাও সেতুং চীনে সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ এর সূচনা করেন। ১৯৭৬ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বিপ্লব অব্যাহত ছিল। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থায় আনুষ্ঠানিক ভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। চীন জাতিসংঘের স্থায়ী কমিটির সদস্য। ১৯৭৮ সালে চীন অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে খোলা-বাজার অর্থনীতি এবং মিশ্র অর্থনীতি পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে। জনসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধির ফলস্বরূপ চীন ‘এক সন্তান পলিসি’ আইন পাশ করে৷ ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ আইন প্রচলিত ছিল৷ ১৯৮২ সালে চীনের বর্তমান সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৯ সালে ঐতিহাসিক তিয়ান আন মেন স্কয়ারে সংঘটিত ছাত্র বিদ্রোহ সশস্ত্র  সেনাবাহিনী দ্বারা অবদমনের জন্য তৎকালীন চীন সরকার আন্তর্জাতিক ভাবে নিন্দিত হোন। ২০০১ সাল থেকে চীন বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার সদস্য। বর্তমানে ১৪টি দেশের সাথে চীনের সীমান্তরেখা রয়েছে। ২৩টি প্রদেশ, ৪টি মিউনিসিপালিটি, ৫টি সায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং ২টি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল নিয়ে এ দেশটি গঠিত৷ দেশটির রাজধানী বেইজিং এবং বৃহত্তম শহর সাংহাই। হংকং এবং ম্যাকাও চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল। ১৮৪২ সালে আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর হংকং এবং এর সংলগ্ন দ্বীপসমূহ ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়, পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চীন হংকং কে ব্রিটিশদের ইজারাভুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। ৩০শে জুন, ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে হংকং এর কর্তৃত্ব হস্তান্তর করে, তবে শাসনব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভিন্নতা থাকায় ২০৪৭ সাল পর্যন্ত হংকং স্বাধীনভাবে পরিচালিত হবে চীনের হস্তক্ষেপ ছাড়া৷ হংকং পৃথিবীর অন্যতম বানিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক দেশ হিসেবে পরিচিত। ম্যাকাও ১৫৫৭ সাল থেকে পর্তুগিজদের উপনিবেশ হিসেবে কার্যকর ছিল৷ ২০শে জুন, ১৯৯৯ সালে পর্তুগিজ সরকার এ অঞ্চলটি চীনের কাছে হস্তান্তর করে। বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের কারণে ১৯৯৭ সাল থেকে চীনে ‘এক দেশ, দুই নীতি’ শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে। চীনের জাতীয় মুদ্রা ইউয়ান, তবে হংকং ডলার এবং পাটাকা যথাক্রমে হংকং ও ম্যাকাও এর মুদ্রা। বর্তমান রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ২০১২ সাল থেকে দেশটির শাসনকার্য পরিচালনা করে আসছেন। চীনের সেনাবাহিনীর নাম ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’। উত্তর কোরিয়ার পর বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনী দল রয়েছে চীন এর৷ চীনের বৃহত্তম নদী ‘হোয়াংহো’। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম খাল ‘গ্র‍্যান্ড’ ক্যানাল’ চীনে অবস্থিত। দেশটির উত্তরপ্রান্তে পৃথিবীর সপ্তাশার্যের একটি ‘দা গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’ অবস্থিত। ১৩,১৭১ মাইল দৈর্ঘ্যের এই প্রাচীরটির নির্মাণকাল খ্রিষ্টপূর্ব ২২০-২০৬। এ স্থাপনাটি মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান।

চীন পৃথিবীর প্রাচীনতম অর্থনৈতিক শক্তি৷ উর্বর জমি এবং জনবহুল হওয়ায় কৃষি, শিল্প ও বিজ্ঞানে এ জাতি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে আসছে৷ বারুদ, কাগজ এবং কম্পাস সর্বপ্রথম এ অঞ্চলে উদ্ভাবিত হয়। ১৯৭০ সালে চীন পৃথিবীর পঞ্চম রাষ্ট্র হিসেবে ‘দং ফাং হং ১’ নামক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে প্রেরণ করে। ২০২১ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে মঙ্গলগ্রহের মাটিতে রোভার ‘ঝুড়ং’ প্রেরণ করে। চীনে পৃথিবীর বৃহত্তম বুলেট ট্রেন এবং সড়ক ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ গ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় ৭০টিরও বেশি রাষ্ট্র এবং সংস্থার মাঝে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্ভব হবে। বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ আমদানিকারক রাষ্ট্র চীন। তাছাড়াও শুষ্ক কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, প্রযুক্তিজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারক হিসেবেও চীন প্রথমস্থানে রয়েছে। সারাবিশ্বের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৪০% চীনের দখলে। হুয়াওয়ে এবং লেনোভো বিশ্বখ্যাত চাইনিজ প্রযুক্তি প্রস্তুত এবং রপ্তানিকারক কোম্পানি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীনের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৩.১ ট্রিলিয়ন ডলার। 

১৯৫০ সাল থেকে চীনের আওতাধীন থাকলেও তিব্বতে সবসময়ই চীন সরকারের প্রতি অসমর্থন ছিল। এর জের ধরেই বিখ্যাত বৌদ্ধধর্মীয় যাজক এবং আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা ভারতে পলায়ন করেন। ভারতের হিমাচল প্রদেশের ম্যাকলয়েডগঞ্জ ধর্মশালায় দালাই লামা বর্তমানে অবস্থান করেন। ১৯৮৯ সালে দালাই লামা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন৷ তিব্বত ছাড়াও জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের উপর সাম্প্রদায়িক গণহত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে চীন সরকারের বিরুদ্ধে।

ভারত এবং চীনের মাঝে সীমান্ত বিরোধ রয়েছে৷ ভারত এবং চীনের সীমান্তরেখাকে ‘ম্যাকমোহন লাইন’ বলা হয়। ভারতের সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে এ দুই রাষ্ট্রের মাঝে সীমান্ত বিরোধ বিদ্যমান। তাছাড়াও ভুটানের সাথেও চীনের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। 

২০০৩ সালে হংকং এ সার্স রোগ দেখা দেয় যা পরবর্তীতে মহামারীর আকার ধারণ করে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে সর্বপ্রথম চীনের উহান প্রদেশে সার্স কোভিড আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। করোনা ভাইরাসের কারণে এ রোগটি হয়৷ তারপর থেকে রোগের প্রকোপ ক্রমান্বয়েই বাড়তে থাকে এবং সারাবিশ্বে এই রোগের কবলে এখন পর্যন্ত ৪.৫৫ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। চীন এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যথাক্রমে সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাক নামের দুইটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন এবং উৎপাদন করেছে। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে এ ভ্যাকসিন নিয়মিত রপ্তানি করছে চীন।

লিখেছেন 

সুমাইয়া আলম চৌধুরী

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply