You are currently viewing ঠগী – আকাশ মজুমদার

ঠগী – আকাশ মজুমদার

  • Post category:Chapakhana

 

একফালি রুমাল ছিলো যাদের শিকারের অস্ত্র…

~ ঠগী

চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। তার মধ্যে শত শিখায় সতীদাহের চিতা জ্বলছে।শিশুহত্যা,দাস ব্যবস্হা,সন্তান বিসর্জন ইত্যাদি শত পথে বিভ্রান্ত মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছে।এমনকি বিপুল আধ্যাত্নিক ভান্ডার সামনে থাকলেও সাধু সন্ন্যাসীরা ধর্মের নামে হাতিয়ার তুলে নিচ্ছে। বর্গীদের মত,পিন্ডারীদের মত, ‘নাগা সন্ন্যাসী’, ‘বৈরাগী’, ‘গোসাঁই’, ‘দাদুপন্থী’।বাংলার সন্ন্যাসী সেদিন নাকি অনেক সাধক দলের সাথে শাস্ত্রের বদলে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল।ইতিপূর্বে তা ছিল না। পরেও না। এ শুধু সেদিনেরই ইতিহাস যখন বর্তমানই একমাত্র কাল। ওরা তখন সিদ্ধিরায় বাহিনীভুক্ত,কেউ জয়পুরের।কেউবা নিজেরাই নিরন্ধ্র অন্ধকারে দুর্ধর্ষ পথিক দল। ঠগী তাদেরই সহযাত্রী -তাদের মধ্যে সবচেয়ে খুনে নিপুণের দল। ঠগী সেই অন্ধকার যুগের সার্বোত্তম প্রতীক।

 

 ঝাঁক ঝাঁক সেপাই হারিয়ে যেত। ছুটি নিয়ে দল বেঁধে দেশে যেত,আর ফিরত না। ফৌজের কর্তৃপক্ষ কিছুকাল অপেক্ষা করতেন,তারপর নাম কেটে দিতেন। পাশে লাল পেন্সিলে লিখে রাখতেন -ডেসার্টার;পালিয়ে গেছে।উত্তর ভারতে তীর্থ করতে গিয়ে দক্ষিণের মস্ত দলটি কোনো দিনই আর গাঁয়ে ফিরত না। আত্নীয়রা অপেক্ষা করতেন।তারপর কেঁদে কেটে আবার সংসারে মন দিতেন। কোন স্মরণীয় সন্ধ্যায় অথবা নিঃসঙ্গ শয্যায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিতেন -ভাগ্যবান ছিল,গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে। বনপথে বাণিজ্য করতে গিয়ে ভূপালের  সওদাগর তখন ঘরে ফেরে না,পাঁচ দিনের পথ ভেঙ্গে ছেলে মায়ের কোলে ফিরতে পারে না। লোকে বলত বাঘে খেয়েছে। নয়তো সাপে কিংবা অজ্ঞাত কোন ব্যাধিতে।

 

 উশবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তার আগের তিনশ বছরে প্রতি বছর গড়ে অন্তত চল্লিশ হাজার মানুষ হারিয়ে গেছে এদেশের কোল থেকে।গিনেস বুক হিসেবে এই সংখ্যা ২০ লক্ষ!

শত শত বছর ধরে এইভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় হারিয়ে যেত অগণিত পথিক।কোথায়? কীভাবে? হারাত, জানত না কেউ। কোনো এক জাদুবলে যেন তারা মুছে যেত পৃথিবীর বুকে।নিরীহ পথিকদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যেয়ে হত্যা করে তাদের মালামাল লুট করত যারা!

এরাই ছিল ঠগী।

ইতিহাসের হিংস্রতম খুনী ওরা। এই ঠগীরা ছিল ১৭ আর ১৮ শতকের প্রথমদিকে ভারতের পথিকদের জন্য মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম।

ওদের কাছে মানুষ স্রেফ শিকার।

ওদের জীবনের একটাই লক্ষ্য মানুষ খুন!

ওদের নেশা মানুষ খুন!

“পান কা রুমাল লাও

সাহেব খান তামাক লাও”

দেখতে দেখতে স্বাভাবিক আর পাঁচটা বাক্যের মত মনে হলেও এ ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যু। যার উদ্দেশ্যে এই বাক্য উচ্চারিত হতো,তারা অদ্ভূত ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যেতো এ পৃথিবী থেকে।ঠগীদের ভাষায় এই বাক্য হলো ‘ঝিরণী’। ‘ঝিরণী’ দেওয়ার পর শিকারের কেউ আর বেঁচে ফিরতো না ।

 

~ কেমন ছিল এই ঠগীদের খুনের পদ্ধতি?

 

ঠগীরা সবসময় চলত দল বেঁধে। তারা ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রী কিংবা সৈন্যের ছদ্মবেশে ভ্রমন করত। এদেরই লোকজন গোপনে বাজার কিংবা সরাইখানা থেকে পথযাত্রীদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য যোগাড় করত। তারপর যাত্রীদের সঙ্গে মিশে যেত। যাত্রা বিরতিতে যাত্রীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করত। সহযাত্রীদের সৌহার্দ্য, নিরাপত্তা আর বিশ্বাসের উষ্ণ আমেজে, গরম খাবার খেয়ে পথ চলতি ক্লান্ত যাত্রীরা নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে থাকেন। আর তখনই আসতো সর্দারের হুকুম। সর্দারের নির্দেশ পাওয়া মাত্রই যাত্রীদের ওপর ঘটতো নির্মম হত্যাকাণ্ড। একজন যাত্রীকে খুন করত তিনজনের একটি দল। একজন মাথা ধরে রাখত,অন্যজন ফাঁস পরাত, আরেকজন পা চেপে ফেলে দিত। কেউ পালিয়ে গেলেও রক্ষা নেই, ঠগীদের অন্য দলটি কাছে পিঠেই ওত পেতে থাকত।

এই ঠগীরা নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করতো। যেমন- ‘বাসন মেজে আনার কথা’ বলার মধ্য দিয়ে সর্দার তার এক সাঙেতকে কবর তৈরি করার নির্দেশ দিত। ‘ঝিরনী’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের  মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো। এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে ফাঁস জড়ানো হতো শিকারের গলায়। যেকোনো সংগঠিত অপরাধী সমাজের মতোই এরূপ নিজস্ব নানা সাঙ্কেতিক ভাষায় ঠগীরা নিজেদের মধ্যে কথা আদান প্রদান করত। গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এই সংকেতের পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব।

 

বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। দলের সদস্যদের খুবই নির্দিষ্ট সব দায়িত্ব ছিল। সর্বাগ্রে থাকতো ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করা, তার সাথে ভাব জমানোর ও শিকার সম্পর্কে নানা তথ্য যোগাড়ের দায়িত্ব থাকতো তাদের ওপর। পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখতো যারা তাদেরকে বলা হতো ‘তিলহাই’, তারা দল থেকে খানিকটা পিছনে থাকত। নিরাপদ জায়গা দেখে তাঁবু গড়ার দায়িত্ব থাকত ‘নিসার’দের উপর।

 

কবর তৈরি করারে দায়িত্ব যার তাকে বলা হতো ‘বিয়াল’। শিকারকে যে ধরে রাখবে তাকে বলা হতো ‘চামোচি’। শিকার যাতে বাধা দিতে না পারে তার জন্য হাত আটকে রাখার দায়িত্ব ‘চুমোসিয়া’র। ‘চুমিয়া’ শিকারের পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে। ‘ভোজারা’ মৃতদেহগুলো কবরে নিয়ে যাবে । ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হলো দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ পাহারা দেয়া ও বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলা হতো ‘ফুরকদেনা’। আর হত্যাকাণ্ডের জায়গাটা সাফসুতরো করে ফেলার দায়িত্ব ছিল ‘ফুরজানা’দের।

সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসত ঠগীদের অমৃতের ভোজ। সে ভোজ আর কিছু নয়, গুড়ের ভোজ। একলা পথিক পেলেই সাদরে তাকে দলের সাথে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাত। তাদের মতে, যে একবার এই গুড় খাবে, সে ঠগী হয়ে যাবে। ঠগীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিল।

 

~ ঠগিদের ফাঁস দেয়ার কৌশলঃ

ঠগীদের খুনের অস্ত্রটা ছিল বেশ অবাক করার মতো। অতি সাধারণ, কিন্তু সাংঘাতিক কার্যকর। এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট। তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বাঁধা। নিপুণ ঘাতকের হাতে সেটাই হয়ে উঠে অব্যর্থ মরণ ফাঁস।

নির্জন পথের পথিক কিংবা তীর্থযাত্রীদের কাছে সাক্ষাৎ যমের দূত হলেও নিজেদের মধ্যে তারা ছিল সৎ।নিজের দলের লোকদের কখনো ঠকাতো না এরা।ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের বিচিত্র ঠগীদের আদী গোত্র ছিল সাতটি…

১। বাহলিম ২।ভিন ৩।ভুজসোত ৪।কাচুনি ৫।হুত্তার ৬।গানু এবং ৭।তানদিল। এই সাত পরিবারের ঠগীরাই যারা ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাদের কর্মকান্ড চালনা করতো।

১৩৫৬ সালে ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানি লিখিত ‘ফিরোজ শাহর ইতিহাস’ গ্রন্থে ঠগীদের কথা প্রথম জানা যায়।কিন্তু বাংলায় তাদের আগমন ঘটে ১২৯০ সালের দিকে। ফিরোজ শাহর ইতিহাস গ্রন্থ হতে জানা যায়, ১২৯০ এর সুলতানী শাসনের সময় প্রায় হাজার খানেক ঠগ ধরা পরে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সুলতান তাদের কোনো রকম সাজা না দিয়ে দিল্লীতে ফিরে না আসার শর্তে, অনেকটা আপ্যায়নের সাথে নৌকায় তুলে দিয়ে ভাটির দেশে- তথা এই বাংলায় পাঠিয়ে দেয়। আর তারপর থেকেই বাংলার জলে-স্থলে, মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পরে এই খুনির দল। বাংলায় ঠগীদের ইতিহাসের সূত্রপাত সম্ভবত এখান থেকেই।

 

~ঠগী ধর্মীয় বিশ্বাসঃ

হিন্দু হোক,মুসলিম হোক,তারা সকলেই ঠগী।বাংলা,বিহার,উড়িষ্যা এবং মোম্বাইয়ে দুই সম্প্রদায়ের অনুপাত সমান সমান।ধর্মে তারা যে সম্প্রদায়েরই হোক,তারা ঠগী।কোথাও তাদের নাম ‘ফাঁসুড়ে’,কোথাও ‘ফাঁসীগীর’,কোথাও ‘অরিতুলুকর’,কোথাও ‘তন্তাকালেরু’।কিন্তু যে নামেই জানুক তাদের সকলেই ঠগী।তাদের হাতিয়ার এক,ভাষা এক,জীবন এক,পেশা এক,ধর্ম এক।

ঠগী ধর্ম এক অদ্ভুত সমন্বয়বাদ।ঠগীরা বলতো তারা ‘মা ভবানী’ বা কালীমাতার সন্তান।

 

~ঠগীরা কি ধরা পড়েছিল!!!

 

ঠগীদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার প্রথম জানতে পারে ১৮১২ সালে । সেসময় গঙ্গার ধারে একটি গণকবর পাওয়া যায়। তাতে ৫০টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। তারপরও বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যাচ্ছিল গণকবর। এসময় ব্রিটিশদের বদন্যতায় যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা পায়। ফলে ঠগীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু পুরোপুরি তাদের মূলোৎপাটন করা যাচ্ছিল না।  ব্রিটিশ সরকার ঠগীদের নিমূর্ল করার জন্য উইলিয়াম শ্লিমানকে দায়িত্ব দেয়।

বেঙ্গল আর্মির অফিসার  উইলিয়াম হেনরি শ্লিমান ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি দেখলেন, কিছুতেই অন্যান্য দুস্কৃতিকারীদের থেকে ঠগীদের পৃথক করা যাচ্ছে না। ঠগীরা নিপুণ কৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল। শ্লিমান গুপ্তচর নিয়োগ করলেন, গঠন করলেন বিশেষ পুলিশ বাহিনী ও আলাদা বিচার আদালত। পাশাপাশি ঠগীদের অপরাধস্থল বিশ্লেষণ করে তৈরি করলেন মানচিত্র এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা তৈরি করলেন যাতে পরবর্তী হত্যার সময়কাল আঁচ করা যায়। নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ সেসব স্থানে পাঠাতে থাকেন।

তারপর ১৮৩০ সালে স্লিমানের গুপ্তচরদের দক্ষতায় ঠগীরা দলে দলে ধরা পড়তে থাকে। এদের কারো কারো মৃত্যুদণ্ড, কারো যাবজ্জীবন জেল, কারো বা দ্বীপান্তর দিয়ে এদের দমন করতে সক্ষম হন। বাকী যারা ছিল তারা ভয়ে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে ভারতবর্ষ ঠগী মুক্ত হয়।

ঠগীদের দীর্ঘ বিচারপর্বে উঠে আসে নানা অজানা বিচিত্র কাহিনী যা শুনে সভ্য সমাজের সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঠগীদের জবানবন্দি থেকে খুনের যে হিসাব পাওয়া যায় তা ছিল খুবই মর্মস্পর্শী। ১৯৩৩ সালে উইলিয়াম স্লিমানের নাতি জেমস স্লিমানের লেখায় জানা যায়, একজন ঠগী মাসে গড়ে  ৮-১০ জনকে খুন করত। সে হিসেবে প্রায় ২০ লক্ষেরও অধিক মানুষ এই ঠগীদের শিকার হয়েছিল বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যা অস্বীকার করারও কোনো উপায় নেই। কারণ বাহরাম বলে এক নিষ্ঠুর ঠগীর নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ৯৩১ জন মানুষকে সে খুন করেছিল বলে দাবি করে এবং পরবর্তীতে ঐ নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডে ওঠে। সে আরেক গল্প।

 

গ্রন্থপঞ্জীঃ

১। ঠগী-শ্রীপান্থ

২। মৃত্যুদূত-নাজিমুদ্দীন আহমেদ

৩। ফিলিপ মিডোয টেলর এর ঠগির জবানবন্দি-মারুফ হোসেন

৪। সপ্তরিপু-রবিন জামান খান

 

 

Leave a Reply