You are currently viewing অতুলপ্রসাদ সেন

অতুলপ্রসাদ সেন

অতুলপ্রসাদ সেন (২০ অক্টোবর ১৮৭১ – ২৬ আগস্ট ১৯৩৪) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভুত একজন বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তিনি একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতবিদও ছিলেন। তার রচিত গানগুলির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম। তার জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তার গানের ভাষায় বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছিল; “বেদনা অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন”।

তাদের আদি নিবাস শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মগর গ্রামে। অতি অল্পবয়সেই অতুলপ্রসাদ পিতৃহারা হন। বাল্যকালে পিতৃহীন হয়ে অতুল প্রসাদ ভগবদ্ভক্ত, সুকণ্ঠ গায়ক ও ভক্তিগীতি রচয়িতা মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। পরবর্তীকালে মাতামহের এসব গুণ তার মাঝেও সঞ্চালিত হয়।

অতুল প্রসাদ ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাশের পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন ও কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। পরে লন্ডনে গিয়ে আইন শিক্ষা করেন। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারিস্টারী ডিগ্রী লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে আইন পড়তে অতুলপ্রসাদ লণ্ডনে গমন করেন।

আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯৪ সালে তিনি বাংলায় ফিরে আসেন এবং রংপুর ও কলকাতায় অনুশীলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি লখনউ চলে যান এবং সেখানে অবধ বার অ্যাসোসিয়েশন ও অবধ বার কাউন্সিলের সভাপতি হন।

কিছুদিন পর বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সেখানে গেলে মামাতো বোন হেমকুসুমের মঙ্গে অতুলপ্রসাদের প্রেম হয় এবং তিনি হেমকুসুমকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন ভারতবর্ষের আইনে ভাই-বোনে এরকম বিয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল না। আর এ ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে ওঠে প্রবল আপত্তি। অতুলপ্রসাদ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ তার কর্মগুরু সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের পরামর্শক্রমে স্কটল্যান্ড গমন কনে যেখানে এরূপ বিবাহ আইনসিদ্ধ ছিল। স্কটল্যান্ডে গিয়ে ১৯০০ সালে মামাতো বোন হেমকুসুমকে বিয়ে করেন অতুলপ্রসাদ।

বিলেতে পসার জমাতে পারেন নি অতুলপ্রসাদ। এসময় মারাত্মক অর্থকষ্টের মোকাবিলা করতে হয়। দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয় যার মধ্য একজনের অকাল মৃত্যু হয়। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জীবিত সন্তান দিলিপকুমুরকে নিযে ভারতে তথা কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় আত্মীয়-স্বজনরা কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। লখনউ বসবাসকালে অতলপ্রসাদের মা হেমন্তশশীর দ্বিতীয় স্বামী দুর্গামোহনের মৃত্যু হয়। দুর্গামোহনের মৃত্যুর পর হেমন্তশশী লখনউ চলে যান পুত্রের সংসারে। এসময় শ্বাশুড়ি বৌমার বিসম্বাদ শুরু হয়। পরিণতিতে স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি। ছাড়াছাড়ি মিটিয়ে একসঙ্গে থাকার চেষ্টাও সফল হয়নি।

হেমন্তশশী ও হেমকুসুমের দ্বন্দ্ব্ব মেটেনি কখনো। হেমন্তশশীর মৃত্যুর পর ঘরে তার ফটো টাঙানো ছিল। তা সরিয়ে ফেলার দাবী তোলেন হেমকুসুম। কিন্তু মায়ের ছবিকে এভাবে অসম্মান করতে নারাজ অতুলপ্রসাদ। এবার হেমকুসুম চিরকালের জন্য স্বামীর ঘর ছেড়ে গেলেন, আর প্রত্যাবর্তন করেন নি।

লক্ষ্মৌতে অতুল যেখানে বাস করতেন জীবনকালেই তাঁর নামে ঐ রাস্তার নামকরণ করা হয়। তার উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ তিনি স্থানীয় জনসাধারণের সেবায় ব্যয় করেন। তার বাড়ি এবং গ্রন্থস্বত্বও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করে গেছেন।

অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র অতুলপ্রসাদ লেখাপড়ার পাশাপাশি অল্প বয়সেই সঙ্গীত চর্চায় মনোযোগী হন। মাতামহের নিকটই সঙ্গীত ও ভক্তিমূলক গানে তার হাতেখড়ি। তিনি ব্যারিস্টারি পেশার মধ্যে পাননি অন্তরের আনন্দ তাই তেমন ভাবে ওতে মন বসাতে পারেননি। তাঁর মনের ভেতরে ঝর্ণা ধারার মতোন নিত্য বহমান ছিলো সুরের মূর্ছনা, কবিতার গুঞ্জণ। বাংলাভাষীদের নিকট অতুলপ্রসাদ সেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত।

তাঁর গানগুলি অতুল প্রসাদের গান নামে বিশেষ ভাবে প্রতিষ্ঠিত। অতুলপ্রসাদ বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক। গীতিগুঞ্জ (১৯৩১) গ্রন্থে তাঁর সমুদয় গান সংকলিত হয়। এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে (১৯৫৭) অনেকগুলি অপ্রকাশিত গান প্রকাশিত হয়। তার গানের সংখ্যা ২০৮টি। এর মধ্যে মাত্র ৫০-৬০টি গান গীত হিসেবে প্রাধান্য পায়।

তাঁর গানগুলি প্রধানত স্বদেশীসঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান এ তিন ধারায় বিভক্ত। যদিও তাঁর জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি গানের ভাষায় বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছিল; ‘বেদনা’ অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন। এজন্য তাঁর অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণরস-প্রধান।

তার রচিত গজলের সংখ্যা মাত্র ৬-৭টি হলেও তিনিই বাংলা ভাষায় প্রথম গজল রচয়িতা। অতুলপ্রসাদ সেনের কয়েকটি বিখ্যাত গান হল- মিছে তুই ভাবিস মন, সবারে বাস রে ভালো,বঁধুয়া, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে, একা মোর গানের তরী, কে আবার বাজায় বাঁশি, ক্রন্দসী পথচারিণী ইত্যাদি। তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী, বলো বলো বলো সবে, হও ধরমেতে ধীর -ইত্যাদি।

তাঁর ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’ গানটি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ অণুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে ১৯১৩ সালে লেখা এই গানটিতে তিনি বাঙালি এবং বাংলা ভাষার প্রতি গভীর প্রেম ও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

এই মাতৃভাষাপ্রেমপূর্ণ সঙ্গীতটি বাঙালির প্রাণে আজও ভাষাপ্রেমে গভীর উদ্দীপনা সঞ্চার করে এবং গানটির আবেদন আজও অম্লান। অতুলপ্রসাদের গানগুলি দেবতা, প্রকৃতি, স্বদেশ, মানব ও বিবিধ নামে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। অতুলপ্রসাদী গান নামে পরিচিত এই ধারার একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী হলেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘খামখেয়ালী সভা’র সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বিলেত ফেরত অতুলপ্রসাদ কোলকাতার উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। শিল্প ও সৃজন জগতের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে ‘খামখেয়ালী সভা’র সদস্য হওয়ার সুবাদে।

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ হিমালয় ভ্রমণের পর রামগড় গেলে, তাঁর আমন্ত্রণে অতুল প্রসাদ রামগড়ে গিয়ে কিছুদিন কাটান। ‘খামখেয়ালী সভা’র মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, লোকেন পালিত, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, রাধিকামোহন গোস্বামী প্রমুখ সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন।

রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, বাউল, কীর্তন, ঠুমরি, রাগপ্রধান সব ধরণের সুর, তাল, লয়ের সমন্বয়ে আজন্ম তিনি এক স্বতন্ত্র সঙ্গীতের সাধনা করেছেন। সে কারণেই সমকালীন গীতিকারদের তুলনায় সীমিত সংখ্যক সঙ্গীত রচনা করেও বাংলা গানের জগতে অতুলপ্রসাদ নিজস্ব একটি আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন।

তাঁর রচিত গান দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি শ্রোতার মর্মস্পর্শী হয়ে আছে। বাউল ও কীর্তনের সুরের যোগসাধন করে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে হিন্দুস্থানী ঢঙের সংযোজন করে তিনি বাংলা গানে বৈচিত্র্যের সঞ্চার করেছেন। অতুল প্রসাদের মামাতো বোন সাহানা দেবীর সম্পাদনায় ৭১টি গান স্বরলিপিসহ কাকলি (১৯৩০) নামে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর গানগুলিও গীতিপুঞ্জ এবং কয়েকটি গান নামে দুটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২২-২৩ সালের দিকে কলকাতা থেকে প্রথম অতুল প্রসাদের গানের রেকর্ড বের হয় সাহানা দেবী ও হরেন চট্রোপাধ্যায়ের কণ্ঠে।

অতুলপ্রসাদ প্রবাসী (বর্তমানে নিখিল-ভারত) বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি উক্ত সম্মিলনের মুখপত্র উত্তরার একজন সম্পাদক এবং সম্মিলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও গোখেলের অনুবর্তী হিসেবে তিনি প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে লিবারাল ফেডারেশন বা উদারনৈতিক সংঘভুক্ত হন ও এর বার্ষিক সম্মিলনে সহ-সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন।

অতুলপ্রসাদ তাঁর সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থের বৃহদংশ স্থানীয় জনকল্যাণে ব্যয় করেন; তাঁর উপার্জনের একটা বড় অংশ জীবিতকালেই লোকসেবায় ব্যয় করেছিলেন; অবশিষ্ট সম্পত্তির বেশির ভাগই, তাঁর আসবাব-গৃহ এবং গ্রন্থস্বত্বও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করে গেছেন। বৃটিশ ভারতের লক্ষ্ণৌতে বসবাসকালে তিনি ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট মারা যান। সেখানেই তার শেষকৃত্য হয়।

Leave a Reply