You are currently viewing আলীগড় আন্দোলন – সাদিয়া ইবনাত মালিহা

আলীগড় আন্দোলন – সাদিয়া ইবনাত মালিহা

 

ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজদের প্রতি বিদ্ধেষ পোষণ করে মুসলমানগণ ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। তাছাড়াও এদেশের মুসলমানরা বিশ্বাস করতো ইংরেজি শিক্ষাগ্রহণ করা একটি পাপ কাজ। ফলে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে মুসলমানদের কোন বিচরণই ছিল না। অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়েছিল মুসলমানরা।এ অবস্থা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য ব্যাপক শিক্ষা ও সমাজসংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান, যা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।

 

আলীগড় আন্দোলনঃ

পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়কে যুক্তিবাদী আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার জন্য স্যার সৈয়দ আহমেদ খান উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে খ্যাত।

 

আলীগড় আন্দোলনের পটভূমিঃ

ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথমদিকে হিন্দু – মুসলিম সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। ব্রিটিশ সরকার মহাবিদ্রোহের জন্য মুসলিমদের বেশি দায়ী করেছিল। অপর দিকে মুসলমানরা ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তনকে সন্দেহের চোখে দেখত। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়ায় সরকারি চাকরির উচ্চপদগুলি , প্রভাব – প্রতিপত্তি সবদিক থেকে মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দুদের তুলনায় অনেক গুণ পিছিয়ে পড়ে। হিন্দুদের তুলনায় অনগ্রসর পাশ্চাত্য শিক্ষায় উদাসীন মুসলিম সমাজের দুরবস্থার কথা সৈয়দ আহমেদ খান অবগত ছিলেন। তিনি ইংরেজি ভাষার মাধমে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রগতির যথার্থ সোপান বলে মনে করতেন, তাই তিনি মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসারে উদ্যোগী হন ।

 আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিয়োডোর বেকের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সৈয়দ আহমেদ খাঁ পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের নিয়ে আলিগড় কলেজকেন্দ্রিক এক আন্দোলন গড়ে তােলার প্রচেষ্টা নেন।

 

আলীগড় আন্দোলনের ভিত্তি:

আলিগড় আন্দোলন চারটি মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।

মুসলিম স্বার্থ :

ভারতের হিন্দু ও মুসলমান আলাদা দুই জাতি , তাদের পারস্পরিক স্বার্থ আলাদা – এই প্রচার আলিগড় আন্দোলনের মূল ভিত্তি রচনা করে।

মুসলিমদের বঞ্চনা:

সরকারি শিক্ষানীতির সমালোচনা করে বলা হয় , উচ্চ সরকারি পদগুলিতে নিয়োগ পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। কেননা পাশ্চাত্য শিক্ষাহীনতার অজুহাতে সরকারি উচ্চপদগুলি থেকে মুসলিমদের উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ আনুগত্য:

মুসলমানদের উদ্দেশে বলা হয় , জাতীয় কংগ্রেস অপেক্ষা ব্রিটিশের প্রতি নির্ভরশীল থাকা অনেক বেশি নিরাপদ ও সুবিধাজনক | কারণ , সরকারি দয়া দাক্ষিণ্যের সুযোগ নিয়ে মুসলমানরা নিজেদের সামাজিক অবস্থান উন্নত করতে পারবে।’ দ্য লয়াল মহামেডানস অব ইন্ডিয়া’ নামক এক গ্রন্থে সৈয়দ আহমেদ লেখেন। হিন্দুস্থানে মুসলিমরাই একমাত্র জাতি , যারা খ্রিস্টানদের বিপদে বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়াবে।”

জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ :

হিন্দুরা যাতে একতরফাভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে না পারে তার জন্য মুসলিমদের আরও বেশি সংখ্যায় জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিয়ে বিবিধ সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায় ছিল আলিগড় আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।

 

আলিগড় আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যঃ

১| ব্রিটিশের সাহায্য নিয়ে মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো।

২| এই আন্দোলনের প্রতি মুসলিম সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক দরিদ্রশ্রেণির অংশগ্রহণ ঘটেনি। ।

 ৩| উত্তরপ্রদেশের গুটিকয়েক জমিদারশ্রেণি ও শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ছিল এই আন্দোলন।

৪| এই আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের অবতারণা। অর্থাৎ এই আন্দোলনের সূত্রেই ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দু – মুসলিম দুটি আলাদা জাতি — এই ধারণার উদ্ভব ঘটে।

 

কার্যক্রমঃ

১| মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার, নারী শিক্ষার প্রতি অবহেলা ইত্যাদি ব্যাপারে পত্রিকার মাধ্যমে সমালোচনা করা হতো।মুসলমানদের সচেতন করে তোলার জন্য তাহকি-উল-আখলাক” নামে একটি করা হয়। তাছাড়া এ সময়ে আলীগড় ইনস্টিটিউট নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয় ১৮৬৬ সালে।

 ২| মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ উর্দু ভাষায় অনুবাদ করার জন্য গঠন করা হয় অনুবাদ সমিতি(১৮৬৬ সাল)। পরবর্তীতে এটি “সাহিত্য ও বিজ্ঞান পরিষদ” নামে খ্যাতি লাভ করে এবং মুসলমানদের জ্ঞান বিস্তারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখে।

৩| পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, মুসলমানদের ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরীকরণ, ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষ পরিহার, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রকৃতির জন্য গড়ে তোলা হয় “মোহামেডান এডুকেশন কনফারেন্স”।

এর ফলে মুসলমান ও ইংরেজদের মাঝে ব্যবধান দূর হয়ে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠত হয়।

৪| ১৮৭৫ সালে মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ এবং ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আলীগড় কলেজ। ১৯২০ সালে আলীগড় কলেজটি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় উন্নীত হয়। মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে ১৮৬৪ সালে গাজীপুরে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া জনগণের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একই বছর উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহে স্থাপন করা হয় একটি শিক্ষা কমিটি।

৫| মুসলমানদের শিক্ষাবিস্তার ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৮৮০ সালে ” মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন” অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের মাধ্যমে মুসলমানদের জানবিজ্ঞান ও সাহিত্য প্রচারিত হয় এবং তাদের মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯০৬ সালে এ সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।

৬| ব্রিটিশ ও মুসলমানদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন ও মুসলমানদের জন্য সুযোগ আদায়ের সঙ্গে তিনি গঠন করেন ব্রিটিশ ভারত সমিতি, ‘এডুকেশন কংগ্রেস”, ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান পেট্রিয়াটিক এসোসিয়েশন”  ও ‘মোহামেডান এ্যাংলো অরিয়েন্টাল ডিফেন্স এসোসিয়েশন’ ইত্যাদি আছে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা লাভ করা।

 

 ফলাফলঃ

১| এ আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের মুসলমানদের সংগঠিত করা সক্ষম হয়। ফলে মুসলমানদের ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে একত্রিত করে তাদের সুযোগ-সুবিধা আদায় সহজ হয়।

২| আলীগড় আন্দোলন মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত করে। এ আন্দোলনের ফসলই হলো আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত “আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে আজও মুসলমান শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করছে।

৩| মুসলমানদের স্বাধীন সত্তা লাভে সক্ষম করে এ আন্দোলন। মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিল এ আন্দোলন।

৪| এ আন্দোলনের প্রভাবে তখনকার সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিন শ্রেনীর উদ্ভব হয়।

৫| তৎকালীন মুসলিম সমাজে প্রচলিত “ইংরেজদের সাথে মেলামেশা ও ইংরেজি শিক্ষা লাভ করা পাপ কাজ”- এ ভুল ধারণার অবসান ঘটে আলীগড় আন্দোলনের প্রভাবে। যার ফলস্বরূপ  মুসলমানরা কুসংস্কার মুক্ত হয়ে অধঃপতিত অবস্থা থেকে রক্ষা পায়।

আলীগড় আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করে। হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকা মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য আলিগড় আন্দোলনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এই আন্দোলনের সুফল হিসেবে মুসলিম সমাজ আগের থেকে অনেকটাই কুসংস্কার ও গোঁড়ামি মুক্ত হয়ে আধুনিক রূপ লাভ করে। বিশেষ করে শিক্ষা ও অধিকার আদায়ে এ আন্দোলন ছিল একটি বিমূর্ত প্রতীক।

আলীগড় আন্দোলনের সুফল আজও মুসলমানরা ভোগ করছে।

আলীগড় আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন “উনিশ শতকের নবজাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দুদের কাছে যা ছিল , আলিগড় আন্দোলনও মুসলিমদের কাছে ছিল ঠিক তাই”। ( There can be no gain saying the fact that the Aligarh movement was not muslim what the Renaissance and Nationalist movement on the 19th century was to the Hindus’)

 

লিখেছেন – সাদিয়া ইবনাত মালিহা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

 

This Post Has One Comment

  1. শেখ মনজুর এলাহী শওকত

    মাশা-আল্লাহ চমৎকার লেখনী

Leave a Reply