You are currently viewing ইয়ং বেঙ্গল

ইয়ং বেঙ্গল

“সত্যের জন্য বাঁচা,সত্যের জন্য মরা”, পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এর এই উপদেশটি সামনে রেখে ডিরোজিওর প্রিয় একদল বুদ্ধিদীপ্ত হিন্দু কলেজের ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু ইয়ং বেঙ্গলের।

ইয়ং বেঙ্গল হলো হিন্দু কলেজের ছাত্রদেরকে সমসাময়িক কলকাতা সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত সামাজিক বুদ্ধবাদী একটি অভিধা বিশেষ।ডিরোজিও সতেরো বছর বয়সে কলকাতার হিন্দু কলেজে শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন।তিনি তৎকালীন সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করে বিজ্ঞান মনস্ক ও যুক্তিবাদী সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইয়ং বেঙ্গল দল গড়ে তুলেছিলেন।ইয়ং বেঙ্গল গঠনে ডিরোজিও তার ছাত্রদের যে জীবনও সমাজ প্রক্রিয়ার প্রতি যুক্তিসিদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করার দীক্ষা দিয়েছিলেন তার দৃষ্টান্ত হলো “ইতিহাস” আর “দর্শন”।

ডিরোজিওর ছাত্ররা ছিলেন মুক্তচিন্তা দ্বারা উজ্জীবিত। প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিক শৃঙ্খলমুক্তির উল্লেখযোগ্য প্রয়াস হিসেবে ইয়ং বেঙ্গল এর সদস্যগণ মদ্যপানে আনন্দবোধ করতেন।তারা হিন্দু সমাজের ধর্মীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে ছিলেন। তারা খ্রিষ্টান মিশনারীদের হিন্দু ধর্মীয় আচারের বিরুদ্ধে দেয়া যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করতেন।এই জন্যই দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরো অনেকেই হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করেন।

ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা দুইটি সংগঠন স্থাপন করেন।একটি “অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন”, আরেকটি হলো “সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ”।
অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশান স্থাপিত হয় ১৮২৮ সালে।এখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা হতো।হিউম, লক,ভলতেয়ার এদের রচনাবলী নিয়ে অধ্যয়ন করা হতো এবং বিতর্কের সময় প্রায়ই উদ্ধৃত করা হতো।
সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ এর সভাপতি ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী এবং প্যারীচাদ মিত্র, ও রামতনু লাহিড়ী ছিলেন এর সম্পাদক।

ইয়ং বেঙ্গল কর্তৃক প্রকাশিত কিছু পত্রিকাও রয়েছে।তারমধ্যে ১৮৪২ সাল থেকে প্রকাশিত “প্রগতিবাদী” মাসিক পত্রিকাটি সমসাময়িক সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সমস্যাবলির উপর লেখা প্রকাশ করতো এবং হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ বিষয়ক আলোচনাও স্থান পায়।পরবর্তীতে এটি মাসিক পত্রিকা থেকে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।এই “প্রগতিবাদী” পত্রিকা থেকেই প্রথম বাংলা উপন্যাসের খসড়া “আলালের ঘরের দুলাল” ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো।ধারণা করা হয় ইয়ং বেঙ্গল কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকা সমূহের মধ্যে সর্বশেষ ছিলো “বেঙ্গল স্পেকটেটর”।

বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রচলন ঘটে আধুনিক যুগে।আধুনিক যুগের সূচনা হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যসাহিত্য আদি লেখকদের একজন রামরাম বসু। তার জন্ম ১৭৫১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়।

তিনি বাঙ্গালা ভাষায় কয়েকটি খ্রিস্টধর্ম বিষয়ক বই লেখেন।যেমনঃ রামায়ণ, মহাভারত এবং তিনি যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে উইলিয়াম কেরির মুন্সী ও সংস্কৃতের সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি করতেন তখন তিনি উইলিয়াম কেরিকে বাইবেল অনুবাদেও সহায়তা করতেন।রামরাম বসু একাধারে বাংলা,সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন,কিছু ইংরেজিও জানতেন।ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে তিনি ভারতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে আসা মিশনারী পাদ্রীদের বাংলা শেখাতেন।তার রচিত “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” বাঙ্গালির লেখা প্রথম বাংলা মৌলিক গদ্যগ্রন্থ ও ছাপাখানার মুদ্রিত প্রথম বই।বইটি ১৮০১ সালের জুলাই মাসে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।

রামরাম বসু নিজে রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর হওয়ার কারণে তার প্রধান কীর্তি বাংলা গদ্যে রচিত ষোড়শ শতাব্দীর বারো ভুঁইয়ার অন্তর্গত বাঙ্গালি জমিদার প্রতাপাদিত্যের জীবনী- ” রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” গ্রন্থে ঐতিহাসিক ও লোকশ্রুতির সমাহার পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে লিপিবদ্ধ করতে পেরেছেন।

১৭৯৫ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখে কেরি মালদহ মদনবাটি নীলকুঠির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হলে তিনিও সঙ্গেই যান।১৮০১ সালের ৪ মে রামরাম বসু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় পণ্ডিত পদে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি অনুবাদ ও সাহিত্য রচনা করতেন। ‘গসপেল মেসেন্জার’ গ্রন্থটি “হরকরা” নামে কবিতায় অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে এটি ওড়িয়া ও হিন্দিতেও অনূদিত হয়।১৮০০ সালে তিনি শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন মুদ্রাযন্ত্র ও বাংলা বিদ্যালয়ে জুন মাসে নিযুক্ত হন। ১৮০০ সালেই তিনি ” জ্ঞানোদয় ও খৃষ্টবিরণাংমৃতং” নামে কবিতায় খ্রিষ্ট চরিত রচনা করেন।

“লিপিমালা” নামে আরেকটি গ্রন্থ এটিও বাংলা গদ্যে ১৮০২ সালে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হয়।তিনি তার দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবদানের পাশাপাশি আমাদের আধুনিক যুগের এক নতুন অধ্যায় শুরু করে দিয়ে অবশেষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৭ই আগস্ট ১৮১৩ সালে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে চলে যান এই অনন্য সাহিত্যিক রামরাম বসু।আমরা বাঙ্গালিরা তার প্রতি চির কৃতজ্ঞ। 

বঙ্গীয় নবজাগরণের সূচনালগ্নে বৌদ্ধিক চর্চাকেন্দ্র হিসেবে কলকাতা মহানগরীর উত্থানের আদিপর্বে ১৮০০ সালের ১০ জুলাই কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম চত্বরে প্রতিষ্ঠা পায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিলো ব্রিটিশ আধিকারিকদের ভারতীয় ভাষায় শিক্ষিত করা।এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলা ও হিন্দির মতো ভারতীয় সকল ভাষার বিকাশ ঘটে।


কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টর কখনোই কলকাতায় ট্রেনিং কলেজ চালানোর পক্ষে ছিলেন না।কারণ তাদের এই ধরনের কলেজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান ছিলোনা। ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাদের প্রয়োজনের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের দিকে। ১৮৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ডানা ছেটে দেন। এরপর ১৮৫৪ সালে ডালহৌসি প্রসাশন আনুষ্ঠানিকভাবে এই কলেজ ভেঙ্গে দেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যার পূর্বে অর্থাৎ ১৮০০-১৮৫৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয়দের শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতিতে বিশেষ অবদান রেখেছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানে সহস্রাধিক সংস্কৃত,আরবি,ফার্সি,বাংলা,হিন্দি ও উর্দূ বই ইংরেজিতে অনুদিত হয়।


এই কলেজের প্রতিটি বিভাগে ছিলেন সেই যুগের বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যক্তি।এই প্রতিষ্ঠনে যে সকল প্রধান এশিয় ভাষা শিক্ষা দেওয়া হতো সেগুলো হলো আরবি,হিন্দুস্তানি,ফার্সি,সংস্কৃত ও বাংলা। পরবর্তীতে মারাঠি ও চীনা ভাষা শিক্ষা দেওয়াও শুরু হয়। ফার্সি বিভাগের প্রধান ছিলেন সরকারি ফার্সি অনুবাদক নেইল বি. এডমন্ডস্টোন। তার সহকারি শিক্ষক ছিলেন সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারক জন এইচ. হ্যারিংটন ও সেনা কূটনীতিবিদ ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন। আরবি শিক্ষা দিতেন আরবিদি জন বেইলি। হিন্দুস্তানি ভাষা বিভাগটির দায়িত্বে ছিলো বিশিষ্ট ভারত তত্ত্ববিদ জন বোর্থউইক।সংস্কৃত বিভাগের প্রধান ছিলেন প্রাচ্যবিদ এইচ.টি. জন বোর্থউইক গিলক্রিস্টের উপর।দেশীয় ভাষা বিভগের প্রধান ছিলেন একাধিক ভারতীয় ভাষাবিদ ও বেসরকারি মিশনারি উইলিয়ম কেরি।


বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হলেও সে যুগে কলকাতায় বাংলা শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। সেই যুগের ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা শুধু সংস্কৃত পড়াতেন।উইলিয়াম কেরি তখন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকে হেড পন্ডিত,রামমোহন বাচস্পতিকে সেকেন্ড পন্ডিত ও রাম রাম বসুকে অন্যতম সহকারী পন্ডিতের পদে নিয়োগ দেন।মৃত্যুঞ্জয়কে বাংলা গদ্যের ’সচেতন শিল্পী’ মনে করা হয়। কারন তিনি সংস্কৃতের পন্ডিত হয়েও কলেজের প্রয়োজনে বাংলা লিখতে শুরু করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো –


বত্রিশ সিংহাসন(১৮০২)হিতোপদেশ(১৮০৮),রাজাবলী(১৮০৮)। মৃত্যুঞ্জয় ইংরেঝি জানতেন না। ধারণা করা হয় তিনি কলেজের ইংরেজি জানা পন্ডিতদের থেকে তার বইয়ের উপাদান সংগ্রহ করতেন।
শিক্ষাদানের পাশাপাশি সেই কলেজে অনুবাদ কর্মকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।এই কাজের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ শতাধিক স্থানীয় ভাষাবিদকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।সেই যুগে বাংলা সাহিত্যের কোনো পাঠ্যপুস্তক পাওয়া যেতো না। ১৭৮৯ সালের ২৩ এপ্রিল “ক্যালকাটা গেজেট” বাংলার অধিবাসিদের নিকট বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান রচনার জন্য একটি বিনীত অনুরোধ প্রকাশ করেন।
শিক্ষাদানের প্রয়োজনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা হয়। এই গ্রন্থাগারে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহিত পুথিপত্র এবং কলেজের নিজস্ব প্রকাশনার বই পত্রও রাখা হয়।পরবর্তীকালে বহু ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বইপত্রও সংরক্ষণ করা হয়।কলেজ ভেঙ্গে দেয়ার সময় এই বিরাট গ্রন্থসংগ্রহ নবগঠিত ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিকে দান করা হয়।বঙ্গীয় নবজাগরণের যুগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা এবং ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তার ধ্বংস এ এক বিরল ইতিহাস।


লিখেছেন-

নাহিদা সুলতানা ইলা

শেরপুর সরকারি কলেজ। 

Leave a Reply