You are currently viewing ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙ্গালি শিক্ষাবিদ,গদ্যকার ও সমাজ সংস্কারক। তার প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগরের পূর্ব পুরুষদের আদি নিবাস ছিলো পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার অন্তর্বর্তী বনমালীপুর নামক গ্রামে। কিন্তু বিদ্যাসাগরের পিতামহ রামজয় দেশ ছেড়ে চলে গেলে ভাগ্যের ফেরে বিদ্যাসাগরের ঠাকুমা শ্রীমতি দুর্গাদেবী তার পিতৃভূমি বীরসিংহ গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেই থেকে তারা বীর সিংহ গ্রাম নিবাসী।

চার বছর নয় মাস বয়সে পিতা ঠাকুরদাস বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন।কিন্তু সনাতন বিশ্বাস বিদ্যাদানের চেয়ে শাস্তি দানেই অধিক আনন্দ পেতেন। সেই কারণে আট বছর বয়সে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী যুবকের প্রতিষ্ঠিত পাঠশালায় তিনি অধ্যয়ন শুরু করেন। তার চোখে “কালীকান্ত” ছিলেন আদর্শ শিক্ষক।

১৮২৮ সালের নভেম্বরে পাঠশালা শেষ করে কলকাতায় আসেন উচ্চশিক্ষা লাভের আশায়। ১৮২৯ সালের ১ জুন সোমবার কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন তার বয়স ছিলো নয় বছর। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন “মদনমোহন তর্কালঙ্কার”। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায় মোট সাড়ে তিন বছর ঐ শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেন।ব্যাকরণ পড়ার সময় মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি পান,এবং “আউট স্টুডেন্ট” হিসেবেও একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান।ছাত্র জীবনে প্রতি বছরেই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ লাভ করতেন। ১৮৩৭ সালে সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর “ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা” নামে স্বাক্ষর করতেন।

১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ‘ল’ কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬মে ‘ল’ কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে “বিদ্যাসাগর” উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।

১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর সেই বছরই ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ৫০ টাকা বেতনে বাংলা বিভাগে প্রধান পণ্ডিত হিসেবে যোগদান করেন।পরবর্তীতে পঁচিশ বছর বয়সে একই বেতন হারে সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহন করেন।১৮৪৭ সালে এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের প্রথম গ্রন্থ “বেতাল পঞ্চবিংশতি”।বিদ্যাসাগর ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানাও স্থাপন করেন বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের অংশীদারিত্বে।১৮৪৭ সালে কলেজ পরিচালনার বিষয় নিয়ে সেক্রেটারি রসময় দত্ত এর সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় সম্পাদক পদটি ত্যাগ করেন।এরপর ১৮৪৯ সালে ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেই হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন।১৮৫০ সালের ৪ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ইস্তফা দিয়ে ৫ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন।

বিদ্যাসাগরের চরিত্র ছিলো কঠোর ও কোমলের মিশ্রণ। তিনি একজন সমাজ সংস্কারক হওয়ায় দেশের সকল সাধারণ মানুষকে তিনি সাহায্য করতেন।দেশের আপামর দরিদ্রসাধারণ তাকে জানতো ‘দয়ার সাগর’ নামে।বিদ্যাসাগরের চরিত্রের অন্যতম গুণ ছিলো মাতৃভক্তি। ধারণা করা হয় বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলন ও মুক্তচিন্তার নেপথ্যে তার মা ভগবতী দেবীর বিশেষ প্রেরণা ছিলো।বিধবা বিবাহ প্রবর্তনেও তার মায়ের বিশেষ অবদান ছিলো।নারী শিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন বিদ্যাসাগর।বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে ভারতে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় “হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়” স্থাপন করেন।

বিদ্যাসাগর রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ বর্ণ পরিচয়,ঋজুপাঠ,ব্যাকরণ কৌমুদী। অনুবাদ গ্রন্থ হলোঃ বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, ভ্রান্তিবিলাস ইত্যাদি। আরো রয়েছে বাঙ্গালার ইতিহাস, বোধোদয়, কথামালা, অতি অল্প হইল,আবার অতি অল্প হইল,ব্রজবিলাস, রত্নপরীক্ষা প্রভৃতি।

বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার মনে করা হয়।যদিও বাংলা গদ্যের জনক তিনি নন।কারণ বাংলা সাহিত্যে তার আসার পূর্বেই গদ্যরচনার শুরু হয়েছিল কিন্তু তখন গদ্যে কোনো শিল্প ছিলোনা,নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি।পরবর্তীতে যখন বিদ্যাসাগর যখন গদ্য রচনা শুরু করেন তখন তার গদ্য ছিলো সরস,সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দময় ও গতিশীল। এই অর্থে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা।তিনি আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক।তাই বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অপরিসীম। 

Leave a Reply