You are currently viewing জাতীয়তাবাদের স্বরুপ
জাতীয়তাবাদের স্বরূপ

জাতীয়তাবাদের স্বরুপ

  • Post category:Others

একসময় জাতীয়তাবাদী চেতনায় ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পৃথিবীর বহু শোষিত ও নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী দাসত্বের নিগড় থেকে মুক্তি পেয়েছে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক পরাধীন ও অবদমিত জাতি বিভিন্ন সময়কালে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদের  বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্রতী হয়েছে। এছাড়া কোনো জনসমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে, কোনো জাতির নিজস্বতা ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠাকরণে এবং তার আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে জাতীয়তাবাদ। বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, দূরপ্রাচ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের জাতিসমূহ ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিপক্ষে লড়াই করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই বাঙ্গালীরা শোষকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। পৃথিবীর অসংখ্য জাতি, গোষ্ঠী,  সম্প্রদায়কে স্বতন্ত্র পরিচয় প্রদান করেছে জাতীয়তাবাদ।

 একবিংশ শতকের পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদের তুলনামূলক আলোচনা এবং সার্বিক মূল্যায়ন বেশ প্রাসঙ্গিক। তবে তার আগে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া দরকার ‘জাতীয়তাবাদ কী?’

জাতীয়তাবাদ শব্দটি বহুমাত্রিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। জাতীয়তাবাদ হল কতকগুলো বিষয় সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ভুখন্ডে বসবাসরত জন সমষ্টির একাত্মবোধের প্রকাশ। এটি এমন এক আদর্শ যেখানে নিজ জাতিকে মানবসমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয় এবং অন্যান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে নিজেদের সুপিরিয়র বলে ভাবা হয়। একটি নির্দিষ্ট  জনসমষ্টির আবেগ অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার ঐক্যবোধের ফসল হল জাতীয়তাবাদ। এটি একটি রাজনৈতিক ধারণা। এর মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব অর্জন, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং বাইরের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

পৃথিবীর সকল জাতীয়তাবাদে দুটি বৈশিষ্ট থাকে। এক, নিজেদের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ এবং দুই, অন্যদের থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যবোধ।

একটি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা কয়েকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে জাগ্রত হয়। যেমন- সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সাদৃশ্য, ভাষা, বর্ণ-গোত্র, ধর্ম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, একই পূর্বপুরুষ হতে আগমন, একই অর্থনৈতিক স্বার্থ ইত্যাদি। যেকোনো ধরনের জাতীয়তাবাদই অন্য জাতি কিংবা রাষ্ট্রের উপর প্রাধান্য, প্রভাব বিস্তার এমনকি আগ্রাসন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করে থাকে।

জাতীয়তাবাদ একটি আধুনিক ধারণা। ১৮ শতকে এর উদ্ভব ঘটে। ইতালির প্রখ্যাত দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের জনক বলা হয়।প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে জাতীয়তাবাদের উত্থান একটি। ১৯ শতকে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সার্বিয়া, পোল্যান্ডে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।

মধ্যযুগ বা মধ্যযুগ পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদ গণমুক্তির সমার্থক হয়ে উঠেছিল যখন মধ্যযুগীয় ইউরোপে চার্চের অত্যাচার এবং নৈরাজ্যকর ফতোয়া জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল সে সময়। জাতীয়তাবাদ তখন আবির্ভূত হয়েছিল একটি সেক্যুলার ইউনিট হিসেবে। জাতীয়তাবাদ তখন এক বিবেচনায় ছিল ইতিবাচক ও গণউত্তরণমুখী। তখনো গণতন্ত্র প্রস্ফুটিত হয়নি। রাজতন্ত্রের দৌরাত্যে মানুষ  অতিষ্ট থাকলেও  তখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের দ্বৈততা স্পষ্ট ছিল না। এ দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হবার জন্য পৃথিবীকে ফরাসি বিপ্লব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

জাতীয়তাবাদের বিকাশ লাভের পরবর্তী সময়ে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সার্বভৌমত্বের ধারণা। যা মানুষের মধ্যে এনে দিয়েছে নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবার প্রবণতা। মানুষ হয়ে পড়েছে  জাতীয়তাবাদ সর্বস্ব ও সার্বভৌমত্ব সর্বস্ব। এই ধারণায় অবরুদ্ধ হয়ে মানুষ ভাবতে শিখেছে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রই মানুষের শেষ এবং একান্ত আশ্রয়। যেন অন্য সব জাতি, অন্য সব মানুষ সবাই আমার প্রতিপক্ষ। যেন আমার জাতিই প্রথম এবং আমার জাতিই শেষ কথা। যেন অন্যেরা অবান্তর। তাদের দমন করা যায়। নিপীড়ন করা যায়। পরিত্যাগ করা যায়। এভাবে এক সময় জাতীয়তাবাদ ভুল হাতে পড়ে হয়ে উঠেছে ফ্যাসিবাদ। হিটলার মুসোলিনীদের উত্থান হয়েছে। এর জন্য পুরো মানবজাতিকে ভয়াবহ মাশুল দিতে হয়েছে। ইউরোপ সহ পুরো বিশ্ব এর ভুক্তভোগী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সহ  জাতিতে জাতিতে  আরো অনেক সংঘাত হয়েছে ঘুরে ফিরে বারবার। ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে হিরোশিমা, নাগাসাকি। বোঝাই যায়নি, এর ভেতরে ভুল কিছু আছে কি না। এর বাইরে বিকল্প কিছু আছে কি না। বিকৃত জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিপুল  সমাহার হয়েছে দেশে দেশে। রাষ্ট্রকে ঘিরে শক্তি ও মর্যাদা সমার্থক বিবেচিত হয়েছে। মানুষ বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলে তার দেশের এতগুলো নিউক্লিয়ার অস্ত্র আছে।এতগুলো যুদ্ধবিমান আছে। ট্যাংক আছে৷ সাবমেরিন আছে৷ অথচ মানুষ ভাবেনা এগুলোর প্রত্যেকটি আরো হাজারো মানুষের প্রাণনাশের কারণ।হাজারো স্বপ্ননাশের কারণ। যে মুক্তিঅর্চনা থেকে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রের আদর্শায়ন হয়েছে তার থেকে বিচ্যুত হয়ে জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছে বিভেদের হাতিয়ার। দমন নিপীড়নের হাতিয়ার। । যুদ্ধ সংঘাতের হাতিয়ার। ভয় দেখানোর ও ভয় পাবার হাতিয়ার। 

আত্মপরিচয়ের গৌরব এখন বিকৃত জাতীয়তাবাদের জন্ম দিচ্ছে। এমন এমন বিশেষ পরিচয় আঁকড়ে মানুষ সংঘবদ্ধ হতে চাচ্ছে, যার মাধ্যমে সে প্রতিপক্ষের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করছে। আমি ব্রিটিশ, আফ্রিকান নই;  আমি আমেরিকান, মেক্সিকান নই; আমি শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ নই—এ ধরনের শ্রেষ্ঠত্ববাদী ভাবনা ধ্বংসাত্মক জাতীয়তাবাদের জন্ম দিচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়৷ জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়েছে বর্ণবাদকে। 

জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদ। মুক্তবাজার এবং বিশ্বায়নের কথা বলে পৃথিবীজুড়ে আধিপত্য বিস্তার ও শোষণের যে নয়া পলিসি এবং সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব, আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,  চীন, সোভিয়েত বা ইউরোপের দিকে তাকালে সেটা স্পষ্টই দৃশ্যমান।

প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, এনআরসি, উইঘুরসহ আরো অনেক বড় বড় আন্তর্জাতিক সংকটের মূলে রয়েছে জাতীয়তাবাদ। বর্তমান বিশ্ব জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংঘাত, ঘৃণা ও বিদ্বেষে জর্জরিত৷ জগত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না দেখলেও এসব ঘিরে যুদ্ধ, সন্ত্রাস আর চরমপন্থার বিস্তার দেখছে৷ অসহিষ্ণুতা, সহিংসতায় প্রতিদিন মরছে মানুষ৷  তাই বৃহৎ কোনো স্বপ্ন দেখার বদলে মানুষ এখন নিজেকেই খোঁজে, মানুষে মানুষে সংহতি ক্ষয়িষ্ণু হওয়ায়  জাতি, ধর্ম বা অঞ্চলের পরিচয়ে নিজেকে সাজায়  আর বাকি সবাইকে মনে করে তার প্রতিপক্ষ।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় উগ্র জাতীয়তাবাদের চর্চা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।আন্তর্জতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রকেই মুখ্য কর্মক হিসেবে গণ্য করার ফলে জাতীয় স্বার্থ, রাষ্ট্রের মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব এসব সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ বৈশ্বিক প্রতিযোগীতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ বাস্তববাদে(Realism) বেশী ঝুকছে। অথচ জাতীয়তাবাদের আগ্রাসন রোধে বাস্তববাদকে পাশ কাটিয়ে প্রয়োজন উদারতাবাদের(Liberalism) চর্চা। হিউম্যান রাইটস, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব এসব ধারণা স্বীকার করেই বর্ডার লাইন শীথিল করা, নাগরিক অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া, এক রাষ্ট্রের প্রতি অন্য রাষ্ট্রের আতিথ্যেয়তা ইত্যাদি বাড়ানোর মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। মনে রাখা দরকার, উগ্র জাতীয়তাবাদ কোনো কালে, কোনো দেশে প্রগতি আনেনি। বরং সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে দীর্ঘমেয়াদে দেশকে, সভ্যতাকে পিছিয়ে দিয়েছে।

লিখেছেন-

এম জি আজম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply