You are currently viewing ডেটন চুক্তি – মোঃ মাহমুদুন্নবী

ডেটন চুক্তি – মোঃ মাহমুদুন্নবী

বসনিয়ার-হার্জেগোভিনার ইতিহাস রক্তাক্ত ইতিহাস। বারবার রক্ত ঝরেছে এই ভূখণ্ডে। বিশ্বের বুকে ঘটে যাওয়া অনেক বড় বড় যুদ্ধও হয়েছে এই দেশকে কেন্দ্র করে। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় ঘটে আরেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ১৯৪৫ সালের পর থেকে ইউরোপ অঞ্চলে হয়ে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ। এতে প্রায় এক লাখ মানুষ নিহত এবং ২০ লাখের বেশি লোক গৃহহীন হয়ে পরেছিল, সেই সঙ্গে বসনিয়ার নারীদের সম্ভ্রমহানি, প্রিজন ক্যাম্প, মুসলিমদের গণহত্যাসহ অসংখ্য সমস্যা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, যার সমাপ্তি ঘটেছিল এক ‘অসম’ শান্তিচুক্তির হাত ধরে। এটিই ‘ডেটন চুক্তি’ নামে পরিচিত।

ডেটন চুক্তি

১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বীকৃতি চাওয়া হয়। ১৯৯২ সালের মার্চে এক গণভোটে বসনিয়ার ভোটাররা স্বাধীনতা বেছে নেয়। প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজেৎবেগোচ এটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বসনিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম ৪৪ শতাংশ, সার্ব ৩১ শতাংশ ও ক্রোয়েট ১৭ শতাংশ। এই তিন জাতির প্রতিনিধিত্ব মূলক  সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে। তবে স্বাধীন হয়েও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি, শুরু হয় জাতিগত যুদ্ধ।

স্বাধীনতার এই ঘোষণা বসনীয়-সার্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সার্বীয় সরকারের প্রধান স্লোবদান মিলসোভিচের সহায়তায় বসনীয়-সার্ব বাহিনী এবং যুগোস্লাভ পিপল’স আর্মি রাষ্ট্রটির সার্বীয় অংশ নিজেদের দখলে নিতে রিপাবলিক অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা চালায়। এরপর খুব দ্রুত বসনিয়াজুড়ে যুদ্ধ শুরু হয়। বসনিয়ার বিভিন্ন অংশের (বিশেষ করে পূর্ব বসনিয়ার) জাতিগত জনগোষ্ঠী এই যুদ্ধে অংশ নেয়।

ক্রোয়েশীয় ও সার্বীয় প্রেসিডেন্ট দুজন নিজেদের মধ্যে বসনিয়াকে ভাগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সার্বীয় যুগোস্লাভ সেনাদের সহায়তায় সার্বীয় সংখ্যালঘুরা নিজেদের অঞ্চলগুলোকে ভাগ করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে সারায়েভো দখলদারিত্বে নেমে জাতিগত নিধন শুরু করে। মুসলিমদের গণহত্যা শুরু করে। ক্রোয়েটরাও নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি শুরু করে। ১৯৯২ সালের আগস্টের শেষে বিদ্রোহী বসনীয় সার্বরা বসনিয়ার ৬০ শতাংশ দখল করে নেয়। উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট (ন্যাটো) এতে হস্তক্ষেপ করার পর যুদ্ধের তীব্রতা কমে আসে। ১৯৯৫ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বসনিয়ায় সার্বদের লক্ষ্য করে বোমা ফেলে ন্যাটো বাহিনী। সার্ব জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকা তুজলা, জেপা ও স্রেব্রেনিৎসায় ঢুকে পড়ে মুসলিম নিধন শুরু করে।

১৯৯২ সালে বসনিয়া যুদ্ধের সূচনা। এটি ছিল মূলত জাতিগত লড়াই। যা সংঘটিত হয় মুসলিম বসনীয়, অর্থোডক্স সার্বীয় ও ক্রোয়েশীয় ক্যাথলিকদের মধ্যে। মূল লক্ষ্য ছিল ওই অঞ্চল থেকে মুসলমানদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।১৯৯৫ এর শেষের দিকে বেশ কিছু রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও কংগ্রেসের চাপে অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে সম্মত হয় এবং সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকরের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ১ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত ডেটন পিস কনফারেন্স এবং ২১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ডেটনে ‘দ্য জেনারেল ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট ফর পিস ইন বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা’ প্রণীত হয়। ডেটন শহরে প্রনীত বলেই এটি ‘ডেটন চুক্তি’ বা ‘ডেটন শান্তি চুক্তি’ নামেও পরিচিত। ১৯৯৫ সালে ১৪ ডিসেম্বর প্যারিসে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচ, ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ফ্রেনজো তুজমান এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজেৎবেগোচ।

ডেটন চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার আশেপাশের আঞ্চলিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা। যদিও তা কতখানি অর্জিত হয়েছে তা প্রশ্নের মুখে। ডেটন চুক্তির মাধ্যমে যে মূল বিষয়গুলোতে অংশগ্রহনকারীরা সম্মত হয় সেগুলো নিম্নরূপ-

  • বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া এবং যুগোস্লাভিয়া একে অন্যের সার্বোভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে ও যেকোন বিতর্ক শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা করতে সম্মত।
  • যুগোস্লাভিয়া এবং বসনিয়া-হার্জেগোভিনা একে অপরকে স্বীকৃতী দিতে এবং পারস্পারিক স্বীকৃতির অন্যান্য দিকগুলি নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত।
  •  অংশগ্রহনকারীরা চুক্তির বিভিন্ন এনেক্সে করা প্রতিশ্রুতি গুলোর প্রতি পরিপূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করতে এবং সেগুলোর পরিপূর্নতা দান করতে সম্মত এবং তারা মানবাধিকার ও বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় বাধ্য থাকবে।
  •  উভয় পক্ষই জাতিসংঘের সুরক্ষা কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত শান্তি প্রতিষ্ঠা বাস্তবায়নে এবং যুদ্ধাপরাধ ও আন্তর্জাতিক মানবাতাবাদী আইন লঙ্ঘনের তদন্ত ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে সম্মত।

রেফারেন্সঃ

  1. https://www.kalerkantho.com/print-edition/chakriache/2018/12/12/713438
  2. https://bit.ly/2JGTZZB
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/Dayton_Agreement#Negotiation_and_signature
  4. https://www.peaceagreements.org/view/389#:~:text=Short%20central%20agreement%2C%20with%20a,5%20Agreement%20on%20Arbitration%3B%206
  5. https://bit.ly/3oj2CZq
  6. http://hrlibrary.umn.edu/icty/dayton/daytonsum.html

লিখেছেন,

মোঃ মাহমুদুন্নবী

Bangabandu Sheikh Mujibur Rahman Maritime University

Leave a Reply