You are currently viewing বাংলা হরফ ও পঞ্চানন কর্মকার

বাংলা হরফ ও পঞ্চানন কর্মকার

বাংলা হরফ ও পঞ্চানন কর্মকার 

বাংলা সংস্কৃতির আজ যে লিখিত রূপ তার রূপকার বাংলা ও সংস্কৃত হরফ তৈরির প্রথম শিল্পী পঞ্চানন কর্মকার। জন্ম হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে। তাঁরা পূর্বপুরুষরা পেশায় ছিলেন কর্মকার বা লৌহজীবী। তাঁর জন্মের কয়েক পুরুষ আগে এই পরিবারের পেশা ছিল লিপিকারের। তাঁদের অনুপ্রেরণায় তিনি পথ চলতে শুরু করেন। তাঁর চরিত্রেও পূর্বপুরুষদের এই শিল্প গুণের প্রকাশ ঘটে।

বাংলা হরফগুলোকে কে প্রথম ছেনি দিয়ে কাটেন এ নিয়ে নানান মতভেদ আছে। কেউ বলেন উইলকিন্সের নাম, কেউ বলেন পঞ্চানন কর্মকারের নাম। তবে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও পঞ্চাননবাবু বাঙালিদের মধ্যে প্রথম খ্যাতি লাভ করেছেন কিন্তু কাজটি প্রথম শুরু করেছিলেন উইলকিন্স। এবং উইলকিন্সের কাছ থেকে পরে শেখেন পঞ্চানন কর্মকার। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে চার্লস উইলকিন্স যখন হুগলিতে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের লেখা ‘অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ বইটি মুদ্রণের জন্য প্রস্তুতি নেন, তখন পঞ্চাননবাবু তাঁর প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে বাংলা হরফ প্রস্তুতের কাজে উইলকিন্সকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এই দু’জন মিলে প্রচুর পরিশ্রম করে কাজটি করতে পেরেছিলেন। বইটির মুদ্রণে ছেনিকাটা থেকে শুরু করে ঢালাই করা এবং যে ধাতব হরফগুলি ব্যবহার হয়, তা উইলকিন্স এবং পঞ্চাননবাবুর যৌথ প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছিল।

১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে তখনকার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের উৎসাহে এবং উইলকিন্সের পরিচালনায় কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানায় পঞ্চাননবাবু কাজ শুরু করেন। 

১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে পুরোদমে এই সরকারি ছাপাখানা চালু ছিল, তিনি সেখানে কাজ করতেন। হরফ নির্মাণের কলাকৌশলও তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। রোমান হরফ নির্মাণের তুলনায় বাংলা হরফ নির্মাণ কষ্টসাধ্য। স্বরচিহ্ন ও সংযোগ চিহ্নসহ প্রায় ছয় শত অক্ষর নির্মাণের কাজ এদেশে বিদেশি চার্লস উইলকিন্স ও স্বদেশি পঞ্চানন কর্মকার ছাড়া আর কেউ করেননি। 

১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ উইলিয়াম কেরির সঙ্গে পঞ্চানন কর্মকারের যোগাযোগ হয়। সে বছরই পঞ্চাননবাবু কেরি সাহেবের শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে যোগ দেন। একটি পুরোনো মেশিন নিয়ে কাজ শুরু হয়। শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট সমপ্রদায়ের জন্যে পঞ্চানন কর্মকার এক সেট বাংলা হরফ নির্মাণ করে দেন। তখনকার দিনে প্রত্যেকটি অক্ষরের জন্যে তিনি দাম নিয়েছিলেন ১/০ সিকা।

কিন্তু পঞ্চাননবাবুর মেধা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অল্প দিনের মধ্যে কেরি সাহেবের প্রেস এশিয়ার বৃহত্তম অক্ষর তৈরির কারখানা অর্থ্যাৎ টাইপ ফাউন্ড্রিতে পরিণত হয়।

১৮০১ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চাননবাবু তৈরি হরফ ব্যবহার করে নিউ টেস্টামেন্টর বাংলা অনুবাদ মুদ্রিত হয়। সেটির অনুবাদক ছিলেন উইলিয়াম কেরি।

১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চাননবাবু প্রথম ভারতবর্ষে দেবনাগরী ভাষায় হরফ নির্মাণ করেন। পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি হরফের নকশা বাংলা মুদ্রণশিল্পে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ছিল। পঞ্চাননবাবু তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকারকে তাঁর সমস্ত জ্ঞান ও কলাকৌশল শিখিয়ে দিয়ে যান। মনোহর কর্মকার অত্যধিক পরিশ্রম, ও মেধা দিয়ে সাধনা করে আরবি, বর্মি, চীনা, ফারসি, তেলুগু, মারাঠি প্রভৃতি অন্তত চোদ্দোটি ভাষার হরফ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

বাংলার হরফের প্রথম কাণ্ডারী ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা ভাষায় ছাপার ইতিহাসে ও সংস্কৃত অক্ষরের ছাঁচ তৈরির প্রাণপুরুষ হিসেবে পঞ্চানন কর্মকারকে আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত।

লিখেছেন- 

নাহিদা সুলতানা ইলা

শেরপুর সরকারি কলেজ। 

Leave a Reply