You are currently viewing স্বর্ণকুমারী দেবী

স্বর্ণকুমারী দেবী

স্বর্ণকুমারী দেবী

স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন একজন বাঙ্গালি কবি,ঔপন্যাসিক, গীতিকার,সমাজ সংস্কারক ও সম্পাদক। হ্যানা ক্যাথরিন ম্যালেন্স “ফুলমণি ও করুণার বিবরণ” প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করলেও স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙ্গালি নারী ঔপন্যাসিক।

স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ  কন্যা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ ছিল। স্বর্ণকুমারী দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়,বিদ্যালয়ে তাদের শিক্ষিকা শ্লেটে কিছু লিখে দিতেন সেই লেখাটিই তারা টুকে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কথা জানার পর অযোধ্যানাথ পাকড়াশি নামে এক দক্ষ শিক্ষককে নিযুক্ত করেন মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ ও তার স্মৃতিকথায় একই কথা উল্লেখ করে লিখেছেন বিদ্যালয়ের তুলনায় বাড়িতেই তারা অধিক শিক্ষালাভ করেন।

১৮৬৮ সালে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়।জানকীনাথ নদীয়া জেলার জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান ছিলেন।ঠাকুর পরিবার ছিল পিরালী থাকভুক্ত ব্রাহ্মণ। পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের কন্যাকে বিবাহ করার জন্য জানকীনাথ পরিবারচ্যুত হয়েছিলেন।কিন্তু দৃঢ়চেতা জানকীনাথ ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করে এবং নিজস্ব এক জমিদারি গড়ে তুলে ‘রাজা’ উপাধি অর্জন করেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানবাদী এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠিাতা।একই বছরে অর্থাৎ ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ডিসেম্বর জানকীনাথ এবং স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর জন্মের পর প্রথমা নাতনী ও পুত্রবধূকে আশীর্বাদ করেন জানকীনাথের পিতা। সেই সাথে ছেলের সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি থেকে জানা যায় যে, জানকীনাথ যখন ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তখন স্বর্ণকুমারী দেবী জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর পরিবারের এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঠাকুর সংগীত, নাটক ও সাহিত্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবীও তার সাথে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। সেই থেকেই স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্য সাধনায় পদার্পণ। 

১৮৭৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয় এবং ১৮৭৯ সালে তিনিই প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) ‘বসন্ত উৎসব’ রচনা করেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ধারাটিকে গ্রহন করে স্বার্থকতর গীতিনাট্য রচনায় সফল হয়েছিলেন।

অনাথ ও বিধবাদের সাহায্য করার জন্য ১৮৯৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সখী সমিতি’।

সখী সমিতির উদ্দেশ্য ছিলো যে সকল অনাথ ও বিধবাদের কোনো নিকটাত্মীয় নেই বা থাকলেও তাদের ভরণপোষণের ক্ষমতা নেই ‘সখী সমিতি’ তাদের দায়িত্ব নিবে। যেসব মেয়েদের দায়িত্ব তারা নিবে তাদেরকে তারা লেখাপড়া শিখিয়ে স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ঘটাবে। পরবর্তীতে তারা শিক্ষিত হয়ে গেলে তখন অন্যান্য মেয়েদেরও পড়ালেখা শেখাবে ও পারিশ্রমিক পাবে।

স্বর্ণকুমারী দেবী অনুভব করলেন শুধুমাত্র সদস্যের চাঁদায় সংগঠন পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই তিনি ‘বেথুন’ কলেজে একটি মেলার আয়োজন করেন। সেই মেলার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো ভারতের দেশীয় পণ্য প্রদর্শনী ও বিক্রয় ব্যবস্থা। সেই যুগে এই মেলা কলকাতায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো।

স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবীর মতে, সখী সমিতির নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সরলা রায়ের অনুরোধে সমিতির অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে তার মামা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “মায়ার খেলা” নামক নৃত্যনাট্যটি লিখে মঞ্চস্থ করেছিলেন।

স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা যিনি প্রকাশ্যে কংগ্রেসের অধিবাসী ছিলেন। তার স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন।

তিনি তার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে ৩০ বছর ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ভারতী পত্রিকাটি প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ব্যাপী প্রকাশিত হয়েছিলো। তার মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ ৭ বছর,স্বর্ণকুমারী দেবী ১১ বছর,স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারা ১২ বছর,রবীন্দ্রনাথ ১ বছর,আবার স্বর্ণকুমারী দেবী ৮ বছর,এরপর আবার ৯ বছরের ব্যাবধানে স্বর্ণকুমারী দেবী এই পত্রিকার ভার বহন করেন। তিনি দুই বছর সম্পাদনার পর পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন।

‘ভারতী’ পত্রিকাটি ১৮৭৭ সালে প্রকাশের প্রথম সংখ্যা থেকেই রবীন্দ্রনাথ লেখা শুরু করেন। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিলো ১৬বছর। তিনি এই পত্রিকায় নিয়মিত লেখা শুরু করেন এবং বহু বছর এই পত্রিকায় তার লেখার চাহিদার জন্যই তিনি লিখে যান।

এই পত্রিকার পৌষ ১২৮৬ সংখ্যা থেকে স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাস ‘ছিন্নমুকুল’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়।

তার এই মহৎ কর্মময় জীবনের জন্য ১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণকুমারী দেবীকে “জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন।

বাংলার এই কিংবদন্তী নারী ঔপন্যাসিক ৩জুলাই ১৯৩২ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

লিখেছেন-

নাহিদা সুলতানা ইলা

শেরপুর সরকারি কলেজ। 

Leave a Reply