You are currently viewing ২য় ভার্সাই চুক্তি – মোঃ মাহমুদুন্নবী

২য় ভার্সাই চুক্তি – মোঃ মাহমুদুন্নবী

মানব সভ্যতা ও ইতিহাসের অন্যতম আনুসংগ যুদ্ধ। কিন্তু কোন যুদ্ধই অনন্তকাল পর্যন্ত চলতে পারে না। একদিন না একদিন তাকে শেষ হতেই হয় এবং তা হয় অংশগ্রহনকারী পক্ষ-বিপক্ষের চুক্তির মাধ্যমে। এইসব চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ হয়, হয় শান্তির পথ সুগম। তাই শান্তি চুক্তি হিসেবেই এসব চুক্তি পরিচিত হয়। কিন্তু কিছু কিছু শান্তি চুক্তিও যে অশান্তির অগ্নিকুন্ড জ্বালাতে দেশলাইয়ের কাঠির মতো বিপজ্জনক ভবে ব্যবহার হতে পারে- ‘ভার্সাই চুক্তি (Treaty of Versailles)’ তার অন্যতম উদাহরণ। কেননা, ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে ১ম বিশ্ব যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও এই বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত চুক্তিকেই বিশ্বের বিজ্ঞজনেরা ২য় বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ হিসেবে মনে করেন।

পটভূমি

১৯০৮ সালের অক্টোবরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বৈত রাজতন্ত্র ইউরোপের বলকান অঞ্চলের দ্বৈত প্রদেশ বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় রাজত্বের ঘোষণা দেয়। এটা পূর্বে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ‘আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ’ বসনিয়া-হার্জেগভিনায় তার সাম্রাজ্যবাদী সশস্ত্র বাহিনী সস্ত্রীক পরিদর্শনে যান। অন্যদিকে সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ লোকজন ১৯০৮ সালের এই রাজত্ব ঘোষনায় ক্ষুব্ধ হয়। তারা মনে করতো সেটা সার্বিয়ার অংশ হওয়া উচিৎ। ফরস্বরূপ, ১৯১৪ এ- প্রিন্স ফার্দিনান্দের ভ্রমনকালে কিছু তরুণ তাকে হত্যার ষরযন্ত্র করে এবং ২৮ জুন বসনিয়ার এক সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী যুবক ‘গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ’ পয়েন্ট ব্ল্যাক রেঞ্জ থেকে গুলি করে এই দম্পতিকে হত্যা করে। সাথে সাথে একে একে ঘটতে শুরু করে আরও অনেক ঘটনা। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি দুষতে থাকে সার্বিয়া কে। অন্যদিকে শক্তিধর রাশিয়া করে সার্বিয়ার পক্ষাবলম্বন। আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিও তৎপর হয় এবং রাশিয়া ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে জার্মানির কাছে সাহায্য দাবী করে। শুরু হয় ১ম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সালের ২৮ জুনের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা হয়, তার ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯১৯ সালের একই তারিখে ভার্সাই চুক্তির মধ্য দিয়ে শেষ হয় সেই নরক-যজ্ঞ।

ভার্সাই চুক্তি

ভার্সাই চুক্তি

১ম বিশ্বযুদ্ধে প্রধান যে দুই পক্ষ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল তার একটি আস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি-জার্মানি-যা অক্ষশক্তি হিসেবে পরিচিত এবং এর নেতৃত্বে ছিল জার্মান। অন্যদিকে ছিল মিত্রশক্তি বা গ্রেট ব্রিটেইন-ফ্রান্স-রাশিয়া। কিন্তু এর রেশ ছড়িয়ে পরেছিল ইউরোপের প্রায় সব দেশেই। মধ্য প্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকাতেও লেগেছহিল এর আঁচ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারছিলো না অক্ষশক্তি। তাই ১৯১৭ সালে জার্মান সরকার যুক্তরাজ্যের ততকালীন প্রেসিডেন্ট ‘উইড্রো উইলসনের’ কাছে সাধারণ যুদ্ধবিরতির আহ্ববান জানায়। তার প্রেক্ষাপটে উইড্রো উইলসন তার ঐতিহাসিক ১৪ দফা পেশ এবং এই ১৪ দফাকেই সঠিক শান্তির একমাত্র উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৪ দফার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দফাটি ছিল জার্মানির কাছে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সকল মিত্র পক্ষের ক্ষতিপূরণ দাবী। ইতালির সীমানা পুনর্নিধারণ, স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, সকল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও স্বাধীনতা রাজ্যসীমা নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিপুঞ্জ গঠন করা এবং তুরস্কের সমস্যাগুলোর সমাধানও ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। যদিও ফলপ্রসূ হয়নি সেই ১৪ দফা।

এরপর ১৮ জানুয়ারি, ১৯১৯ সালে  প্যারিসে শুরু হয় শান্তি আলোচনা। রাশিয়া তার পূর্বেই ‘ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তি’ করায় রাশিয়া ছাড়া এই ঐতিহাসিক এই সম্মেলনে যোগদান করেন ২৭ টি মিত্রদেশের প্রায় ৭০ জন কুটনৈতিক। তারা মিলিত ভাবে পরাজিত অক্ষশক্তির জন্য শর্ত প্রস্তুত করতে থাকে। যদিও তাতে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি জার্মানি সহ পরাজিত সমমনা অন্য দেশগুলোকে। প্যারিসের শান্তি সম্মেলনের এই চুক্তিগুলোই পরবর্তীতে ভার্সাই চুক্তি হিসেবে স্বাক্ষরিত হয়। ফ্রান্সের প্যারিসের নিকটকবর্তী ভার্সাই প্রাসাদে (Versailles Palace) স্বাক্ষরিত হয় বলে একে ভার্সাই চুক্তি বলা হয়।

 

প্রাথমিক ভাবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইউনাইটেড স্টেটস, ইতালি এবং জাপান- এই ৫ দেশের ৩ জন করে ১০ জন প্রতিনিধি নিয়ে শর্তাবলী নির্ধারণ শুরু হয়। পরবর্তীতে ১০ সদস্যের পরিবর্তে ৫ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দিয়ে ৫ সদস্যের কাউন্সিল ঘঠন হয় আলোচনার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ, ইতালির ভিট্টোরিও অরল্যান্ডো, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জেস ক্ল্যামেনকু এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন- এই চার ব্যক্তিই মূলত ভার্সাই চুক্তির শর্তগুলো নির্ধারণ করেন এবং এই চারজন ঐতিহাসিক ভাবে ‘বিগ ফোর’ নামে পরিচিত।

ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর

২০০ পৃষ্ঠার এই চুক্তি পত্রটি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় লেখা ছিল। ১৫টি অধ্যায়ে মোট ধারা সন্নিবেশিত ছিল ৪৩৯টি। ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই রাজপ্রাসাদের মিরর হলে মুখোমুখি বসে জার্মানি এবং মিত্র পক্ষের ৩২টি দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে চুক্তিতি  স্বাক্ষরিত হয়। মিত্র বাহিনী কর্তৃক গৃহীত চুক্তি পত্র পড়ে শুনিয়ে দেওয়া হয় জার্মান প্রতিনিধি দলকে। হল রুমে বসেই জার্মান প্রতিনিধি দল সন্ধির শর্তগুলো নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। কারণ চুক্তিগুলো ছিল এক পাক্ষিক। মূল সমস্যা ছিল এই চুক্তিতে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও সেদিন মিত্র বাহিনী কর্তৃক গৃহীত শান্তি চুক্তি পত্রে জার্মানি স্বাক্ষর করে দেয়। কারণ এছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ তাদের জন্য খোলা ছিল না।

ভার্সাই চুক্তির মূল দিকসমূহ

  • ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির সামরিক শক্তি কমিয়ে আনতে বলা হয়, সৈন্য সংখ্যা সর্বোচ্চ ১ লক্ষ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আর এ সকল সৈন্য শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নিয়োজিত থাকবে। নৌ বাহিনীর সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১৫ হাজার। যেসকল যুদ্ধ জাহাজ ও সাবমেরিন রয়েছে তা মিত্র বাহিনীর হাতে সমর্পণ করবে। জার্মানির কোনো বিমানবাহিনী থাকতে পারবে না।
  • বিভিন্ন মহাদেশে জার্মানির কলোনিগুলো মিত্রপক্ষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। এসকল কলোনি আর কখনো জার্মান সাম্রাজ্য ভুক্ত হতে পারবে না। ব্রিটেন, ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে ক্যামেরুন ও টোগোকে ভাগ করে নেবে। জার্মান নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক এলাকা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হস্তান্তর করে দিতে হবে।
  • এ সকল শর্ত কার্যকর করার নিশ্চিত করতে রাইন নদীর পশ্চিম তীরবর্তী জার্মান ভূখণ্ডে মিত্রশক্তি ও তাদের সহযোগী সেনাবাহিনীর দখলে থাকবে ১৫ বছর।
  • এই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির রাষ্ট্রীয় সীমা এবং জনসংখ্যা শতকরা দশভাগ কমিয়ে আনা হয়।
  • পশ্চিম দিকে অবস্থিত অ্যালসেইস ও লোরেইন পুনরায় ফ্রান্সকে দেয়া হয়।
  • পূর্বে অবস্থিত জার্মানির অংশের নাম ছিল পশ্চিম প্রুশিয়া যার নির্দিষ্ট অংশ পোল্যান্ডকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে আছে পোসেন, বাল্টিক সাগরের একটি করিডোর এবং আপার সাইলেশিয়ার একটি অংশ (গণভোটের মাধ্যমে)।
  • উত্তরের তিনটি ছোট ছোট এলাকা বেলজিয়ামের সীমানায় অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু স্ক্লেসভিগে (Schleswig) একটি গণভোটের ফলাফলের সাপেক্ষে এই অঞ্চলের উত্তরাংশটিকে ডেনমার্কের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
  • ড্যানজিগকে একটি মুক্ত শহর ঘোষণা করা হয়। চীন, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আফ্রিকায় অবস্থিত সকল জার্মান কলোনিসমূহ বৃটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং অন্যান্য মিত্রশক্তির কুক্ষিগত হয়।
  • জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহে সংঘটিত জীবন, অর্থ ও অবকাঠামোগত সকল ক্ষয়ক্ষতির জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হয়।

উপসংহার

ভার্সাই চুক্তি থামিয়ে দেয় ১ম বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু জার্মানির একটা দল কঠিন ভাবে ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। অভ্যুদয় ঘটে বিপ্লবী নাৎসি পার্টির। রাজতন্ত্র ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে গনতন্ত্র হয়ে আবির্ভাব হয় ফ্যাসিবাদী হিটলারের। সেও অস্বীকার করে বসে ভার্সাই চুক্তির শর্ত। ফলে পৃথিবী ধিরে ধিরে এগিয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে। তাই ভার্সাই চুক্তি আদৌ শান্তি চুক্তি, নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযিদ্ধের অনুঘটক তা নিয়ে এখনো চলছে বিস্তর আলোচোনা।

রেফারেন্স

  1. https://en.wikipedia.org/wiki/Treaty_of_Versailles
  2. https://en.wikipedia.org/wiki/Assassination_of_Archduke_Franz_Ferdinand
  3. https://www.history.com/topics/world-war-i/treaty-of-versailles-1
  4. https://roar.media/bangla/main/history/treaty-of-versailles-the-treaty-that-ended-wwi
  5. http://itibritto.com/versai-treaty/
  6. https://www.history.com/this-day-in-history/archduke-ferdinand-assassinated#:~:text=The%20archduke%20traveled%20to%20Sarajevo,should%20be%20part%20of%20Serbia.
  7. https://en.wikipedia.org/wiki/Archduke_Franz_Ferdinand_of_Austria
  8. http://ghotona.com/Battles/news/2019/09/26/352
  9. https://history.state.gov/milestones/1914-1920/paris-peace

Leave a Reply