You are currently viewing জুতো – তানভীর আহমেদ

জুতো – তানভীর আহমেদ

  • Post category:Chapakhana

জুতো

 

শ্রদ্ধেয় স্যার,


সালাম নিবেন। জানি অভিমান করে আছেন। অভিমান করার পর্যাপ্ত কারণও আছে আপনার কাছে। আর সেই অভিমান ভাঙানোর মতো উপকরণও আমার নিতান্তই অপর্যাপ্ত। কিছুই বলার যোগ্যতা নেই, তবুও বলার রয়ে গেছে অনেকটা। তাই এই পত্রের সাহায্য নেওয়া।

স্যার, কি লিখবো আজ? বাবা মারা গেলেন সেই অবুঝ রেখেই। তারপর থেকে আপনাকেই তো বাবা বলে জেনে এসেছি। সবটুকু প্রাপ্তিই আপনার থেকেই পাওয়া। আজ আমার যেটুকুই খাঁটি, সেটুকু জুড়ে শুধু আপনিই তো স্যার। মনে আছে স্যার, আদর্শলিপি পড়ার সময় আমি উলটো করে বই ধরতাম, তাই আপনি আমাকে প্রতিদিন মারতেন।
ছোট্ট একটা ভুলের জন্য প্রতিদিন মার খেতাম, আজ আর কেউ আমায় মারে না স্যার। তাই সেই ছোট্ট ভুলগুলো সুযোগ পেয়ে ফুলে ফেঁপে বড় বড় ভুল আর আন্যায়ে পরিণত হয়েছে। সেই অন্যায় এতোটাই ডানা মেলে ফেলেছে যে এই মুখ নিয়ে আপনার পবিত্র মুখের সামনে আর দাঁড়ানো যায় না,স্যার। আমিও তাই আসতে পারলাম না।

স্যার, আজ আদর্শ বলতে কিছুই নেই, সবাই উলটো করেই বই ধরে; আমি চেয়েছিলাম স্যার, খুব চেষ্টা করেছিলাম আপনার শিখিয়ে দেয়া সেই সোজা করে আমার আদর্শলিপিটা তুলে ধরতে। কিন্তু এতো উল্টোর ভীড়ে আমার সোজা করে ধরা আদর্শলিপিটা কেমন যেনো বেমানান লাগে স্যার। তাই আমি পারিনি। আমি পারিনি আপনার মতো নিখাঁদ মানুষ হতে। ক্ষমা করবেন আমায়।

রুমি মতিউরের দেশটা আজ দুর্নীতিতে প্রথম হয়,কেন স্যার? সবাই বিচ্যুত, তা না হলে আজ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলোর সাথে আপনার একটা স্বীকৃতিও থাকতো। কই, আছে স্যার? কেনো নেই? আপনি কি মুক্তিযুদ্ধে একটা পা হারান নি? যে দেশে আপনার মতো মহান কারো ভাগ্যে জোটে একটা ভাঙা পা, আর যারা ভেঙেছে তাদের জোটে দেশের সেরা সম্মান, মুক্তিযোদ্ধা সনদ, সেখানে আপনার সেই আদর্শ চলে না স্যার। নিতান্তই চলেনা।


এস,এস,সির আগে যখন মা মারা গেলেন,তখন তো পরম স্নেহে আপনিই আগলে নিয়েছিলেন। মাথায় বাবার ছায়ার মতো হাত রেখে “চিন্তা করিস না” কথাটা আপনার মতো করে কেউ সেদিন বলেনি স্যার। আপনার পরিশ্রমেই এসএসসি দিয়ে শহরে আসা। খুব মনে পড়ে স্যার, বিশ্রীভাবে মনে পরে। কেনো এলাম আপনার কোল ছেড়ে? অনেকবার আপনার সামনে দাঁড়িয়ে পড়া দিয়েছি কিন্তু এ শহর আমাকে এমনই শিক্ষা দিলো যা নিয়ে আপনার সামনে আর দাঁড়ানো যায় না।

স্যার, ছাত্র রাজনীতি বলতে আপনি যা শিখিয়েছিলেন, এখানে তাকে প্রহসন বলে। আমি জড়াতে চাই নি স্যার, বাঁচতে চেয়েছি শুধু। এখানে গ্রামের মতো সারি সারি গাছ নেই স্যার, অক্সিজেনের বড়ই অভাব। তাই এখানে মিলেমিশে বাঁচা যায় না। বাঁচতে হলে কাউকে মারতেই হয়; আমিও শুধু সেটুকুই করেছি। বাঁচার জন্যই করেছি।

এই বেঁচে থাকার বাহানায় ঠিক কখন যে একটু একটু করে আপনার দেখানো পথ থেকে সরে এসেছি, ঠিক কখন যে কেউ হাত থেকে কলমটা কেড়ে নিয়ে গুজে দিয়েছে একে৪৭, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। এটা স্যার আপনার সেই একে৪৭ নয়,যেটা গর্জে উঠেছিলো ৭১’এ। এটা পাপে মাখা পিস্তল,যার পাপে আজ আমার হাত,সারা শরীর।  স্যার, এটুকু না করলে ওরা আমাকে থাকতে দিতো না, বাঁচতে দিতো না। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না স্যার, এটা সেই দেশটা নয় যা আপনি স্বাধীন করেছিলেন। বিশ্বাস করুন স্যার, প্রথম বর্ষে আমি এমন ছিলাম না। আমার হাতেও সব সময় একটা আদর্শলিপি থাকতো। আমার গর্ব হতো, আপনি যখন আদর্শলিপি বুকে নিয়ে হাঁটতেন, কি সুন্দরই না লাগতো আপনাকে! আমিও আপনার মতো সুন্দরই হতে চেয়েছিলাম। ও’রা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করতো, আমি মেনে নিতাম। ফার্স্ট ইয়ারে আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম স্যার।

সেকেন্ড ইয়ারে একদিন হলে ঘুমিয়ে আছি, পুলিশ এসে ডেকে তুললো। আমার বিছানার নিচে পাওয়া গেলো একটা পিস্তল। আমি তখন কিছুই জানতাম না। আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আমাকে এমন মারা মারলো স্যার, সে মার আর আপনার মার এক নয়! আমি অবুঝ শিশুর মতো কাঁদলাম, আমি এ কাজ করি নি। ও’দের কানে কিছুই গেলো না। মায়ের রেখে যাওয়া সেই চেইনটা,যেটা সব সময় আমি পরে থাকতাম, সেটা ওরা খুলে নিলো স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার, এর চেয়ে বেশি কষ্ট আর কিছুতেই হয় না!


তিনদিন পর আমাদের কলেজের ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতা আমাকে এসে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলো। আমি কি করলাম জানেন স্যার? নিশ্চয় সরল মনে আপনি ভাবছেন আমি নেতার কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। না স্যার, আপনার এ দর্শন ঢাকায় চলে না। আমি তিন দিনের মাথায় ওই নেতাকে খুন করলাম স্যার। আমি জানতাম, আমাকে দলে নেয়ার জন্য পুলিশি এই নাটকটা ঐ নেতার পাতানো খেলা ছাড়া কিছুই নয়। সেই শুরু স্যার। তারপর থেকে হেন কোনো কাজ নেই করিনি। খুন গোটা সাতেক হয়েছে। যে পুলিশ আমাকে বিনা কারণে এভাবে মেরেছিলো,তার সাথে প্রায়ই বিকেলে চা খাই এখন। তিনি আমার পিস্তল মুছে দেন।

পুলিশ তো ছোটখাটো ব্যাপার, এমপি মন্ত্রীদের সাথে আমার নিয়মিত মিটিং থাকতো। কখন যে আপনার দেখো পথ থেকে এতোটা সরে গেলাম স্যার,আজ ভাবতেই গা শিউরে উঠে। তবে গত নির্বাচনে আমার দল হেরে গিয়েছে। মাস ক্ষাণেক হলো, এম মধ্যেই আমার উপর তিনবার হামলা হয়ে গেছে। আমার আর এ দেশে থাকা সম্ভব না। এদেশ এখন ও’দের।

আমি আগামী পরশুর ফ্লাইটে লন্ডন চলে যাচ্ছি স্যার। আর হয়তো আসা হবে না আমার প্রিয় বাংলায়। জীবনানন্দের মতো শঙ্খচিলের বেশেও হয়তো নয়। দোয়া করবেন আমার জন্য।

ফার্ষ্ট ইয়ারে আমি এমন ছিলাম না স্যার, তখন খুব পরিশ্রম করতাম। টিউশনি করে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। এক বান্ধবীর মায়ের অসুখ শুনে শ’তিনেক টাকা ধার দিয়েছিলাম। পরে অনেকবার ফেরত দিতে চেয়েছে, নেই নি।

আজ তার থেকে টাকাটা নিলাম। আমার কাছে এখন এক লাখ বায়ান্ন হাজার টাকা থাকলেও, ওটাই আমার রোজগার করা শেষ হালাল পয়সা। আপনাকে যে জুতোজোড়া পাঠালাম, সেটা সেই টাকায় কেনা স্যার, আমার ঘাম ঝরানো হালাল টাকা।


আপনার পবিত্র চরণে আমি নোংরা ছোঁয়া দেই নি স্যার। আমি কাল সারারাত জুতোটা বুকে নিয়ে শুয়ে ছিলাম। জুতোটা কালো রঙের স্যার। দোহাই লাগে, একটাবার পড়বেন। আমি আপনার পা ছুঁতে পারলাম না, জুতো ছুঁয়েই সন্তুষ্ট থাকবো।

পারলে আমায় ক্ষমা করবেন।


ইতি
আপনার হতভাগা ছাত্র

 

পুনশ্চঃ আমি জানি না আপনি কে, যিনি এতোক্ষণ স্যারকে চিঠিটা পড়ে শোনালেন। স্যার অন্ধ হয়ে যাবার খবর আমি পেয়েছিলাম। আপনি যিনিই হয়ে থাকুন, চিঠিটা আমার স্যারকে পড়ে শোনানোর জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা। স্যারের খেয়াল রাখবেন।
আল্লাহ হাফেয।

Leave a Reply