You are currently viewing বিজয় (তাজিংডং) জয় (পর্ব-০১) – দীপ্ত সেন

বিজয় (তাজিংডং) জয় (পর্ব-০১) – দীপ্ত সেন

 

যদি বাংলাদেশের সবচাইতে বড় পাহাড়ের কথা ভাবা হয় প্রথমেই আসবে তাজিংডং এর নাম। হ্যাঁ, সরকারী হিসেবে তাজিংডং (বিজয়) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড়। অফিসিয়ালি এর উচ্চতা বলা হয় ১২৮০ মিটার (৪১৯৮ ফুট)। কিন্তু আধুনিকতম হিসেব বলে এই পাহাড়ের উচ্চতা ৭৯০ মিটারের আশেপাশে। বেসরকারি ভাবে সাকাহাফং কে বলা হয় আমাদের প্রায় সমতল দেশের সর্বোচ্চ পয়েন্ট। যাই হোক আমাদের গন্তব্য রুমা উপজেলার রেমাক্রি পাংশা ইউনিয়ন সাইচল পার্বত্য এলাকার বন্য আকর্ষণ তাজিংডং। তাজিংডং নামটি একান্তই স্থানীয় মানুষদের। তাদের ভাষায় তাজিং শব্দের অর্থ বড় আর ডং অর্থ পাহাড়, অর্থাৎ সব মিলিয়ে বড় পাহাড়। 

তাজিংডং

 

শুক্রবার, ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১

আমরা মোট ১৯ জন, একজন যোগ দেবে বান্দরবান শহর থেকে আর দুইজন পটিয়া থেকে । বাকি ১৬ জনের যাত্রার শুরু চট্টগ্রাম শহর থেকে। চট্টগ্রাম শহরের বহদ্দারহাট থেকে প্রতি তিরিশ মিনিট অন্তর অন্তর বাস ছাড়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। সময় লাগে মোটামুটি ৩ ঘন্টার মতো। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বেশ সকালেই যাত্রা শুরু করার। তাই ভোর ৫ টা থেকেই শুরু হয় রণসজ্জা। অবশ্য অনান্য জার্নির মতোই সকাল ৭ টার বাস ধরার প্ল্যান থাকলেও তা সফল হয় নি। অবশেষে বহদ্দারহাট থেকে যাত্রা শুরু করতে সমর্থ হই সকাল ৮ টা নাগাদ। আর পটিয়া-চন্দনাইশ-দোহাজারী  হয়ে  বান্দরবান  শহরে পৌঁছাই ১১ টার কাছাকাছি সময়ে। তাজিংডং পাহাড় যদিও রুমা উপজেলায় কিন্তু ওখানে যেতে হয় থানচি থেকে। তাই আমাদের এবারের লক্ষ্য থানচি পৌঁছানো।

 

থানচি বান্দরবানের সবচেয়ে বড় উপজেলা। ১৯৭৬ সালে থানচি থানা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৮৩ সালে থানাকে উপজেলায় প্রতিস্থাপন করা হয়। থানচি নামটির একটি সুন্দর ইতিহাস আছে। এটি মূলত মার্মা একটা শব্দের অপভ্রংশ। শব্দটি হলো থেইন চৈ। যার বাংলা বিশ্রামের স্থান। ১৯৫০ সালের আগে পর্যন্ত নৌপথে যাত্রার আগে যাত্রীরা থানচিতে অবস্থান করতেন তার থেকেই এই নাম। ১৮২৪ সালের ব্রিটিশ-বার্মা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত থানচি ছিল বার্মার (মায়ানমার) এর অধীনে। বান্দরবান শহরের থানচি বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাড়ে থানচির উদ্দেশ্যে বাস, আছে চাঁদের গাড়িও। সড়কসথে বান্দরবান শহর থেকে থানচির দুরত্ব প্রায় ৮২ কিলোমিটার। চাঁদের গাড়ির আসা যাওয়া মিলে খরচ কম বেশি ৯০০০ থেকে ১০০০০ টাকার মতো পড়বে। বাসে করে গেলে খরচ হয় জনপ্রতি ২০০ টাকা করে আসা যাওয়া ৪০০ টাকা। এক চাঁদের গাড়িতে সর্বোচ্চ যেতে পারবেন ১৪ জন। পার্থক্য হবে সময়েও, চাঁদের গাড়িতে সময় লাগে ২.৫-৩ ঘন্টা যেখানে বাসে লাগে ৪-৫ ঘন্টা। যাত্রাপথে বেশ কিছু দর্শনীয় জায়গা পাবেন যেমন নীলগিরি, শৈলপ্রপাত,মিলনছড়ি, চিম্বুক.. যদি এসব জায়গায় নামার ইচ্ছে থাকে তাহলে অবশ্যই চাঁদের গাড়ী মাস্ট। আমরা অবশ্য খরচের কথা চিন্তা করে যাত্রা করি ১১:৩০ এর বাসে।

 

বান্দরবান – থানচি চলাচল করা বাসগুলোর ফিটনেস খুব ভালো তা বলা যায় না। ভীড়ও হয় যথেষ্ট, অনেকটা লোকাল বাসের মতোই। টিকেট কাটার পরও সিট বুঝে পাওয়া নিয়ে ছোটখাটো একটা বচসার পর বাস চলতে শুরু করলো। দশ বছর আগে একবার গিয়েছিলাম এই রোড ধরে। নতুন এই যাত্রায় মনে হচ্ছিল দশ বছরে রাস্তাটা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সময়ের সাথে রাস্তা কখনো উপরে উঠছে, কখনো নামছে। কখনো একদম সোজা ওঠানামা, কখনো বা সাপের মতো ডানে বায়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়ের গা দিয়ে চলছে রাস্তা। ইঞ্জিন তারস্বরে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে এই অত্যাচারের। এরই মাঝে প্রথমে পড়বে মিলনছড়ি। এরপর রাস্তার পাশে একটার পর একটা পাহাড়ি পাড়া, কখনো পাহাড়ি খাদ, কখনো বা পাহাড়ের কাফেলা। হঠাৎ খেয়াল করলাম মানুষের ভিড় বাড়ছে, দেখলাম একটা পাহাড়ি ঝর্ণা। হ্যাঁ এটাই সেই শৈলপ্রপাত। এখন শীতকাল তাই ঝর্ণার পানি প্রবাহ খুব কম। আমাদের বাস এগিয়ে চলছে আরো সামনে, অনাহুত অতিথিদের মতো গাছের ডালপালা ঝাপটে পড়ছে বাসের জানলায়। আশপাশের পাড়া আর অসংখ্য রিসোর্ট ছড়িয়ে চলতে চলতে আমরা এগোচ্ছি। জোহরের আজানের সময় আমরা পৌঁছে যায় চিম্বুকের ক্যাফে ২৭ ফুড মার্টে। এখানে দশ মিনিটের ছোট বিরতি। বিরতি শেষে আবার পথে। এরপরের দর্শনীয় স্থান নীলগিরি হিল রিসোর্ট, বাস অবশ্য এখানে থামে না। পাহাড়ি পাড়া, ঝিরির ওপর ছোট ব্রিজ, পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে যখন মনে হচ্ছিল এক অন্তহীন পথে চলেছি, তখন‌ সামনে পড়লো এক বিলবোর্ডে লেখা “Be a man among men.” এটা বলিপাড়া বিজিবি ক্যাম্প।

 

বলিরহাট ক্যাম্প

 

এরপর আর ঘন্টাখানেকের পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই থানচি। থানচি তে নেমে মক্কা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে ডিম, ডাল, আলু সেদ্ধ সহযোগে খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার। খাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় ৫ টা বাজে। আমাদের গাইড সাহেব সেলিম এসে বলে চাঁদের গাড়ি করে নির্মাণাধীন থানচি-রেমাক্রি-মদক-লিকরি সংযোগ সড়ক ধরে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার। সড়কটিতে আসলে চলাচলের অনুমতি নেই। স্থানীয় লোক ও রাস্তা নির্মাণের সাথে জড়িত মানুষজনই চলাচল করতে পারে। রাতের অন্ধকারে অবশ্য কিছু বাইক ও জিপ চলে। জিপ নিয়ে যখন আলোচনা চলছিল আমি আর রাশিক গেলাম একটু সাঙ্গু ব্রিজের ওপর। সাঙ্গু বান্দরবান শহরের লাইফব্ল্যাড। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হলেও, সাঙ্গুর প্রবাহ দক্ষিণ থেকে উত্তরে। স্বচ্ছ জলধারার জন্য মারমারা এই নদীকে ডাকে রেগ্রীইং খ্যং বা স্বচ্ছ নদী নামে। সাঙ্গু তার স্নিগ্ধতা দিয়ে সারাদিনের বাস ভ্রমনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিলো।

সাঙ্গু নদী

 

অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো রোড ধরে আমরা হেঁটেই আগাবো। সন্ধ্যার অন্ধকার মেখে উঠতি রাস্তায় চড়া শুরু করলাম আমরা। কিন্তু ভাগ্য সহায় না হলে যা হয় আর কি!! বিজিবির জিজ্ঞাসাবাদ পেরিয়ে গেলেও, মিনিট ৪৫ হাঁটার পর এক চেকপোস্টে আটকে দেয়া হয় আমাদের। সেলিম সাহেব মোটেও চেকপোস্টে কথা বলতে রাজি হলো না, টলানো গেল না চেকপোস্টের গার্ড সাহেবকেও। তিরিশ মিনিট বৃথা চেষ্টার পর যখন ফিরে আসছি তখন আকাশের গায়ে ফুটে উঠেছে কালপুরুষ, লঘু সপ্তর্ষী সহ আরো নাম না জানা‌ অসংখ্য নক্ষত্রমন্ডলীর নকশা। সেই নক্ষত্রের আলোয় হতাশা নিয়ে আমরা আবার নেমে আসি থানচি বাজারে। সেলিম আমাদের সামনে আর মুখ দেখানোর ধৃষ্টতা দেখায় নি। মদিনা হোটেলে বসে কথা হয় নয়ন খিয়াং আর সুমন ত্রিপুরা নামের দুজনের সাথে। রাশীদ শাহারিয়ার আর শুভ্র শুভ বের হয় থানচিতে থাকার জায়গার খোঁজে। ১৪ তারিখের পৌরসভা নির্বাচন ও চোখ রাঙাচ্ছিল, আসমিনা, আকাশ আর সবুজের ছিল পরীক্ষা, চাকরির তাড়া। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয় সেগুন ঝিরি হোটেলে। পরিকল্পনা হয় এবার নয়ন দাকে সামনে ভোররাতে রওনা দেবো তাজিংডং জয়ের জন্য। রাতে পদ্মঝিরি রেস্টুরেন্টে সকালের মেনুর সাথে মুরগির মাংস যোগ করে খাওয়া-দাওয়া সারার মাধ্যমে মোটামুটি শেষ হলো প্রথম দিনের অভিযান।

 

This Post Has One Comment

  1. Md Emran Hasan

    ভালো লাগলো

Leave a Reply