চর্যাপদ: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনঃ সৌপ্তিক রায়

বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাসকে যে চারটি যুগে ভাগ করা হয়েছে, তার মাঝে সর্বপ্রথমটি হচ্ছে প্রাচীনযুগ। এই প্রাচীনযুগের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদের সমসাময়িক কালে বাংলাদেশে কিছু সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশ সাহিত্যও হলেও তা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ উপকরণ নয়। 

চর্যাপদ আবিষ্কারের ইতিহাসঃ

চর্যাপদ আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত ‘ময়নামতির গান’, ‘গোরক্ষবিজয়’, ‘শূন্যপুরাণ’, ‘ডাক ও খনার বচন’ এগুলোকে বাঙালি ইতিহাসবিদগণ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে উল্লেখ করতেন। ১৮৮২ সালে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সর্বপ্রথম তাঁর Sanskrit Buddist Literature in Nepal গ্রন্থে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাহিত্যের কথা প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রকাশ করে তৎকালীন ইতিহাসবিদদের মাঝে এক চাঞ্চল্য ও কৌতূহল সৃষ্টি করেন। সেই কৌতূহল নিবৃত্তের লক্ষ্যেই ১৮৯৭-৯৮ সালে দুবার মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল যাত্রা করেন। তিনি মনে করতেন বাংলায় মুসলিম শাসনের পূর্বে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু শাসকদের নিপীড়নে এবং মুসলিম শাসনের সময় ধর্মচ্যুত হবার আশঙ্কায় এদেশের বৌদ্ধ সাধকগণ বাংলা ছেড়ে, তাঁদের ধর্মীয় পুঁথিপত্র ও শিষ্যদের নিয়ে নেপাল, ভূটান ও তিব্বত পলায়ন করেছিলেন। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে তৃতীয়বারের মতো নেপাল পরিভ্রমণ করেন এবং নেপালের রাজগ্রন্থাগার হতে চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণপাদের দোহা এবং ডাকার্ণব নামে কতগুলো পুঁথি আবিষ্কার করেন। তাঁর সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ হতে ১৯১৬ সালে (১৩২৩ বাংলা সনে) সে সকল পুঁথির একটি সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম দেয়া হয় ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’। 

চর্যাপদের পুঁথিটি যে রূপে পাওয়া গেছে তা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে এটি বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত বিভিন্ন কবির রচিত পদের সংকলন। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার আদিম রূপ হওয়ায় পড়ে বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য। তাই এর ভাষার দূর্বোধ্যতা দূর করার জন্য সংস্কৃত সহজবোধ্য টীকা কবিতাগুলোর সাথে যুক্ত ছিল। কিন্তু টীকাকারের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী চর্যাপদের তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করার পর সেখান থেকে সংস্কৃত টীকাকারের নাম মুনিদত্ত বলে নিশ্চিত হও্য়া যায়। যে পুঁথিগুলো প্রথম পাওয়া যায় সেগুলো মুনিদত্তের আসল সংকলন গ্রন্থ নয়, বরং আসল গ্রন্থের অনুলিপি অথবা অনুলিপির অনুলিপি।

চর্যাপদের নামকরণঃ

চর্যাপদের নামকরণ নিয়ে গবেষকদের মাঝে মতভেদ পাওয়া যায়। চর্যাপদের প্রাপ্ত পুঁথির সংস্কৃত টীকাকার মুনিদত্তের মতে এই গ্রন্থের নাম ‘আশ্চর্যচর্যাচয়’। নেপালে প্রাপ্ত পুঁথিগুলোতে এ পদগুলোর নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ড. প্রবোধ চন্দ্র বাগচী এ দুটি নাম মিলিয়ে ‘চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়’ নাম দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অন্যান্য ভাষাবিদেরা এ নামটিকে কৃত্রিম বলে অভিহিত করেন এবং নাকচ করে দেন। চর্যাগীতিগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ এবং টীকা করা হয়। মুনিদত্তের টীকাগুলো তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেন কীর্তিচন্দ্র এবং ‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি’ হিসেবে নামকরণ করেন। এথেকে মনে করা হয় মূল সংকলনের নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ’। আধুনিক পন্ডিতগণ মনে করেন যে মূল সংকলনের নাম ‘চর্যাগীতিকোষ’ এবং সংস্কৃত টীকার নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’। 

চর্যাপদের পদসংখ্যাঃ

চর্যাপদের মোট পদসংখ্যা ৫১। তবে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের পদসংখ্যা ৫০। প্রথম আবিষ্কৃত পুঁথির কিছু অংশ ছেঁড়া থাকায় সবগুলো পদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঐ পুঁথিতে আবিষ্কৃত মোট পদসংখ্যা সাড়ে ৪৬। ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পূর্ণাঙ্গ তিনটি পদ এবং ২৩ নং পদের অর্ধেক পাওয়া যায়নি। ২৪ নং পদটি কাহ্নপা রচিত, ২৫ নং পদটি তন্ত্রীপা রচিত, ৪৮ নং পদটি কুক্কুরী পা রচিত এবং ২৩ নং পদটি ভুসুকু পা রচিত। 

চর্যাপদের কবিঃ

চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে ২৪ জন কবির বা পদকর্তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের কবি ২৩ জন। এঁরা সবাই বৌদ্ধ সহজযানী এবং চুরাশি সিদ্ধার অন্তর্গত। প্রত্যেকের নামের শেষে গৌরবসূচক ‘পা’ যোগ করা হত। এই ‘পা’ দ্বারা তাঁরা নিজেদের পদকর্তা হিসেবে আলাদা করতেন। চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে উল্লেখিত চর্যার ২৪ জন পদকর্তা হলেন- লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কামলি, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, সবর, আর্যদেব, ঢেন্টণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঁঙ্ক, জঅনন্দি, ধাম, তন্ত্রী, লাড়িডোম্বী। 

  • চর্যাপদের সর্বাধিক পদের রচয়িতা কাহ্নপা। তিনি কানুপা বা কৃষ্ণপাদ নামেও পরিচিত। তাঁর রচিত পদসংখ্যা ১৩। এর মাঝে একটি পদ পাওয়া যায়নি। 
  • চর্যাপদের দ্বিতীয় সর্বাধিক পদের রচয়িতা ভুসুকু পা। তাঁর রচিত পদসংখ্যা ৮। 
  • চর্যাপদের তৃতীয় সর্বাধিক পদের রচয়িতা সরহ পা। তাঁর রচিত পদসংখ্যা ৪।  
  • চর্যাপদের প্রথম পদ/কবিতার রচয়িতা লুই পা। তাঁর রচিত সংস্কৃত গ্রন্থ চারটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘অভিসময়বিভঙ্গ’। ধারণা করা হয় চর্যাপদের আদি কবি লুই পা। কিন্তু ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের আদি কবি শবর পা। চর্যাপদের কবিদের মধ্যে শবর পা বাঙালি ছিলেন। 

চর্যাপদের রচনাকালঃ

চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত থাকলেও দুইটি মতবাদ সর্বাধিক জনপ্রিয়।

  • ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের (সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক) মধ্যে।
  • অন্যদিকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে চর্যাপদের রচনাকাল ৯৫০ থেকে ১২০০ (দশম থেকে দ্বাদশ শতক) খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

বেশিরভাগ গবেষকই ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতবাদটি গ্রহণ করেন।

চর্যাপদের ভাষাঃ

চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা ভাষা। চর্যাপদের রচনার শেষ সময়কাল দ্বাদশ শতক। সেই সময়ে বাংলা ভাষা তার স্বকীয় মূর্তি সম্পূর্ণ রূপে লাভ করতে পারেনি। ভাষার প্রাচীনত্বের কারণে গৌড় অপভ্রংশের প্রভাব এতে রয়ে গেছে। ফলে চর্যাপদের ভাষাকে কেউ কেউ অপভ্রংশ, প্রাচীন হিন্দি, মৈথিলি, উড়িয়া বা আসামি ভাষা বলে দাবি করেন। কিন্তু এ সকল দ্বন্দ্ব ওবং মতবিরোধের অবসান ঘটান ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি ১৯২৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Origin and Development of Bengali Language এ বিস্তারিতভাবে ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিচার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, চর্যার সংকলনটি আদিতম বাংলা ভাষাতেই রচিত। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যার ভাষা প্রাচীন বাংলা কিংবা প্রাচীন বঙ্গকামরূপী ভাষা। 

সন্ধ্যাভাষাঃ 

চর্যাপদের ভাষাকে কেউ কেউ সন্ধ্যাভাষা বা সন্ধাভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ চর্যাপদের ভাষা সন্ধ্যার আঁধো আলো আঁধো ছায়ার মতো। কিছু বুঝতে পারা যায়, কিছু বুঝতে পারা যায় না । অনেকের মতে সহজ ভাষায় রূপকার্থে চর্যাপদের কবিরা তাঁদের সাধন পথের অতি নীগূঢ় কথা ব্যক্ত করেছেন পদগুলোতে। মুনিদত্ত টীকার সাহায্যে চর্যার এই আলো-আঁধারি ভাষাকে সহজ করার চেষ্টা করেছেন।

চর্যাপদের ধর্মতত্ত্বঃ

ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর রচিত Buddist Mystic Song গ্রন্থে সর্বপ্রথম চর্যাপদের ধর্মতত্ত্ব নিয়ে কথা বলেন। চর্যাপদের পদকর্তা সবাই বৌদ্ধ সহজযানী। 

চর্যাপদের ছন্দঃ

চর্যাপদের পদগুলো তৎকালীন সময়ে কোন ছন্দে রচিত হয়েছিল তা বের করা সম্ভব হয়নি। তবে আধুনিক ছন্দরীতিতে পদগুলো মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত বলে ধারণা করা হয়। 

বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষার বিগত বছরের প্রশ্নাবলীঃ

১. চর্যাপদের রচনাকাল – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ/ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ। 

২. চর্যাপদে পদ/গান/কবিতা ছিল – সুকুমার সেনের মতে ৫১ টি/ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৫০ টি। 

৩. চর্যাপদের পদকর্তা – সুকুমার সেনের মতে ২৪ জন/ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ২৩ জন।

৪. চর্যাপদের প্রথম পদটির রচয়িতা – লুইপা

৫. চর্যাপদের ছন্দ – মাত্রাবৃত্ত ছন্দ। 

৬. ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ এর অর্থ – কোনটি আচরণীয়, কোনটি নয়।

৭. সবচেয়ে বেশি চর্যাপদ পাওয়া গেছে – কবি কাহ্ন পা এর। 

৮. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন/আদি নিদর্শন/প্রথম কবিতা সংকলন/ প্রাচিনযুগের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন – চর্যাপদ

৯. “টালত মারে ঘর নাহি পড়বেশী, হাড়িতে ভাত নাহি নিতি আবেশী” চর্যাপদের এই চরণ দুটি দিয়ে বুঝানো হয়েছে – দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের চিত্র। 

১০. চর্যাপদের কবির সংখ্যা – ২৪ জন/ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ২৩ জন। 

১১. বাংলাসাহিত্যের প্রাচীনযুগের নিদর্শন – দোহাকোষ 

১২. চর্যাপদের পদগুলো টীকার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন – মুনিদত্ত। 

১৩. চর্যাপদ প্রথম প্রকাশিত হয় – বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে।

১৪. চর্যাপদ রচনা শুরু হয় – পাল রাজবংশের আমলে। 

১৫. ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের ভাষা – বঙ্গকামরূপী। 

১৬. চর্যাপদ প্রথম পাওয়া যায় – নেপালের রাজ গ্রন্থাগারে। 

১৭. চর্যাপদের আবিষ্কারক – মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। 

১৮. চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয় – ১৯০৭ সালে। 

১৯. বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত চর্যাপদ সম্পাদনা করেন – শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। 

২০. চর্যাপদ বাংলা ভাষায় রচিত এটি প্রমাণ করেন- ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।

২১. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ যে গ্রন্থে প্রকাশ করেছিলেন – হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা। 

২২. চর্যাপদ যে ধর্মাবলম্বীদের সাহিত্য – সহজিয়া বৌদ্ধ।

২৩. সন্ধ্যাভাষার প্রয়োগ আছে – চর্যাপদে।

২৪. চর্যাপদের বয়স আনুমানিক – ১০০০ বছর। 

২৫. চর্যাপদের যে পদটি খন্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায় – ২৩ নং পদ।

২৬. চর্যাপদের আদিকবি – লুইপা। 

২৭. ‘Origin and Development of Bengali Language’ গ্রন্থের রচয়িতা – ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। 

তথ্যসূত্রঃ

  • বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – মাহবুবুল আলম
  • বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা – ড. সৌমিত্র শেখর
  • বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তথ্যকোষ – ড. মিজান রহমান
  • ইন্টারনেট

লিখেছেন

সৌপ্তিক রায় 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় 

Leave a Reply