You are currently viewing জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য – আকাশ মজুমদার

জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য – আকাশ মজুমদার

 

জলবায়ু পরিবর্তনে কারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে..

২০১৪ সালে WHO (World Health Organization) অনুমান করেছে যে,পৃথিবীর উষ্ণ জলবায়ু এখন ১৫০০০০ মানুষের মৃত্যু এবং ৫ মিলিয়ন মানুষের অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে,উদাহরণ স্বরুপ ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া যা উন্নয়নশীল দেশগুলির শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর একটি সাধারণ কারণ এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশুদের অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন প্রকার শারীরিক সমস্যা। বলা যায়,দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যধিক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাতের কারণে মশার প্রজনন বাড়ছে। যার ফলে,ডেঙ্গু জ্বর এবং ম্যালেরিয়া সহ মশার দ্বারা ছড়িয়ে পড়া রোগগুলি ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

জন বার্জার, বিভিন্ন রোগের প্রকোপে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব সম্পর্কে যে সকল উদাহরণ উল্লেখ করেন..

নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর আফ্রিকাতে মশাবাহিত রোগের প্রসারে অবদান রেখেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার রিচার্ড বে উল্লেখ করেন দক্ষিণ আফ্রিকা একসময় ম্যালেরিয়া মুক্ত ছিল, কিন্তু ১৯৯৯ সালে প্রায় বাইশ হাজার কেস পাওয়া যায় ম্যালেরিয়ার। ম্যালেরিয়া কেনিয়া এবং তানজানিয়া অঞ্চলেও পৌঁছেছে। যেখানে এর আগে এটি ছিল না।

কলম্বিয়া এর আন্দিজ পর্বতে এ রোগ বহনকারী মশা যেগুলো এককালে ৩২০০ ফিটের চেয়ে বেশি উচ্চতায় বাস করতো তা এখন ৭২০০ ফুট স্তরে উপস্থিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে লাতিন আমেরিকার কলেরা, ১৯৯৪ সালে ভারতে নিউমোনিয়া, প্লেগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হান্ট ভাইরাস মহামারী সহ সাম্প্রতিক দশকে বিভিন্ন পুনরুত্থানের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

সীমাবদ্ধ সম্পদের কারণে, দ্বীপাঞ্চল এর জীবন কখনও কখনও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে যদিও মানুষ সফলভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দ্বীপগুলোতে অভিযোজন করেছে।

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে মেলবোর্ন -অস্ট্রেলিয়ায় শতাব্দীর তীব্র তাপ অনুভব হয়েছে।যা একটানা ১০৯.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর বেশি তাপমাত্রা লক্ষ্য করা যায়।

মেলবোর্ন শহরের “ডিজাইন এবং কালচার” এর পরিচালক রব এডামস এর মতে,”The Economist” এর জরিপে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাসযোগ্য শহর হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য সবচেয়ে অপরিবর্তনীয় প্রমাণিত হয়েছিল এই শহরের তীব্রতা সহ্য করতে না পারায় শুধু প্রাণঘাতী ক্ষতি হয়নি কিন্তু সম্ভাব্য কয়েক ডলারের আয় হারায় এবং সম্পত্তির ক্ষতি হয়।

আন্দিজ পর্বতের হিমবাহের দ্রুত গলে যাওয়া যা মানুষকে তাদের staple crop উৎপাদন করতে বাধ্য করেছে এবং এটি এমন একটি কৌশল যেটি বনভূমি ধ্বংস এবং মাটি ক্ষয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আদিবাসী আর্কটিক লোকেরা,সামুদ্রিক বরফের ক্ষয়ক্ষতি যেটি তাদের ঐতিহ্যবাহী শিকার এবং মাছ ধরার কাজে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বেশ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়। বিলুপ্ত হচ্ছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ।এই সকল আদিবাসী সম্প্রদায় কি আসলেই পারবে নিজেদের অস্বিত্বকে টিকিয়ে রাখতে…।একসময়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ানো নেপালের আদিবাসী সম্প্রদায় রাউতিরা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ,জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে রাউতিদের হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ।

চলুন শুনে নেই,নেপালের প্রায় বিলুপ্ত আদিবাসী সম্প্রদায় রাউতিদের জীবনের গল্প…

~বনজ সম্পদের ধ্বংস আর রাউতিদের হারিয়ে যাওয়া…

জায়গাটি সমতল ভূমি হলেও অত্যন্ত বিপদজনক; কেননা এর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার বরফাচ্ছাদিত পর্বত হিমালয়। কিছুদিন আগেও এক ভূমিধ্বসে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাউতিরা। এখন তারা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে বড় ধরনের সংকটে আছে। যেকোনো মুহূর্তে একটি ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ চিরতরে মুছে দিতে পারে ছোট্ট এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের অবশিষ্ট সদস্যদেরকে।

বর্তমানে এই ঐতিহাসিক সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা মাত্র ১৫০ জনের কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রায় বিপন্ন এক বনজ আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম রাউতি।

রাউতিরা বর্তমানে নেপাল সরকারের তালিকাভুক্ত আদিবাসী সম্প্রদায়। ঐতিহাসিকভাবে তাদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান নেই; কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা নেই; কোনো গৃহপালিত পশুপাখি নেই; খাদ্যের সংরক্ষণাগার নেই; পুরোপুরি বনের ওপর নির্ভরশীল এক যাযাবর জাতি। ক্রমান্বয়ে স্থান পরিবর্তন করে বনের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করা তাদের ঐতিহ্য। লঙ্গুর ও ম্যাকক প্রজাতির বানর শিকার এবং বন্য আলু তাদের খাদ্যের প্রধান উৎস। এছাড়া বনের লতা-পাতা ও ফল-ফলাদিও তারা ভক্ষণ করে থাকে।

দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত অধিকাংশ জিনিসপত্র, যেমন- বাদ্যযন্ত্র, অলঙ্কার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদিও তারা বন্য গাছ ও লতাপাতার সাহায্যে তৈরি করে থাকে।  

বনের শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে তাতে আগুন জ্বেলে অস্থায়ী চুলায় তারা রান্নাবান্না করে। রান্নার সময় পরিবারের অধিকাংশ সদস্য চুলার চারপাশ ঘিরে গোল হয়ে বসে; এটি তাদের একটি ঐতিহ্য। একে অনেকটা গোত্রীয় বা পারিবারিক সংসদের সাথে  তুলনা করা যেতে পারে; এ সময় তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।

তারা কখনো বন্য সম্পদ বিক্রি করে না, যেহেতু বন তাদের আশ্রয় দেয়, তাই বনকে তারা ‘বাড়ি’ হিসেবে গণ্য করে। তাদের বিশ্বাস অনুসারে, বন্য সম্পদ বিক্রি করা মানে, নিজেদের বাসস্থান নিজেরা ধ্বংস করে ফেলা।

রাউতিদের পারিবারিক প্রথায় নারী-পুরুষের শ্রম বিভাজন দেখা যায়। শিকার করা, খাদ্য সংগ্রহ করা, বাসস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ ঘরের বাইরের কাজগুলো সাধারণত পুরুষরা করে থাকে। ফসল খাওয়ার উপযোগী করা, রান্নাবান্না করা, সন্তান লালন-পালন করা সহ ঘরের যাবতীয় কাজগুলো নারীদের করতে দেখা যায়।  

বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাংবাদিক কেট হামবেল রাউতিদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। সেই ডকুমেন্টারি তৈরির অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন,

তারা অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। তাদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৫০ এর চেয়েও কম হবে। তারাই নেপালের সর্বশেষ যাযাবর আদিবাসী সম্প্রদায়। যে বন তাদের ঐতিহাসিক বাসস্থান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে, সেই বন ধীরে ধীরে অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।

একসময় বন ছিল রাউতিদের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে তারাও ছিলেন স্বনির্ভর। কিন্তু দিন দিন বন উজার আর দখল হয়ে যাওয়ায় তারা পড়েছেন বিপাকে। বর্তমানে তারা বাধ্য হয়ে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করছেন। তবে এই সাহায্যকে কখনই তারা ইতিবাচকভাবে নেননি; তারা চেয়েছেন তাদের আবাসস্থল বনের ওপর পূর্ণ অধিকার; কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের এই সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য করছে; বিনিময়ে কেড়ে নিচ্ছে তাদের ঐতিহাসিক আবাসস্থল ঘন বনাঞ্চল। তাদের এই দুঃখ সমতলের কিংবা আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত কোনো মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন কেট। 

রাউতিদের বসতি:

রাউতিদের নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করছেন বাটসক নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া গবেষক। জানা গেল, বাটসকের এই গবেষণার কাজটি মোটেও সহজ নয়। তিনি একটি খনিজ সম্পদ খনন কোম্পানিতে এক মাস কাজ করেন এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিয়ে চলে আসেন রাউতিদের নিবাসে। তারপর তাদের সাথে একাকার হয়ে গিয়ে অনুসন্ধান করেন রাউতিদের আনন্দ-বেদনা ও ঐতিহ্যের ইতিহাস। বাটসক তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন,

“এসব যাযাবর পরিবারের সাথে বসবাস করতে গিয়ে আমার দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে; প্রথমত, নিঃসন্দেহে এমন জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন; দ্বিতীয়ত, তাদের জীবনযাপন যতই অদ্ভুত হোক না কেন, ভাগ্য তাদের সাথে আছে। তা না হলে প্রকৃতির  নিষ্ঠুরতা বহু আগেই হয়তো তাদের নিঃশেষ করে দিত।”

বাটসক আরও বলেন-

“আমি আরও একটি বিষয় গভীরভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি: তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই-ই তাদের এই লড়াকু মানসিকতা গড়ে দিয়েছে; যা আমাদের মতো সাধারণ পরিবেশে জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়।”

তবে কীসের ভিত্তিতে রাউতিরা বারবার স্থান পরিবর্তন করে- এটি নিয়ে উৎসুকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে। ব্রিটিশ সাংবাদিক কেট হামবেলের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, যখন তাদের মধ্য থেকে কেউ মারা যায়, তখন তার সৎকার শেষে তারা সেই স্থান পরিত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যায়।

এছাড়া যখন আবাসস্থলের আশেপাশে বেঁচে থাকার অবলম্বনের সংকট দেখা দেয়; শিকার কমে আসে, বৃক্ষ কমে যায়, তখন তারা সেই স্থান পরিবর্তন করে। আরেকটি কারণ জানা যায়, যা রহস্যময়- কখনো কখনো তাদের ওপর স্থান ত্যাগের দৈব ইশারা আসে, তখনও তারা তাদের স্থান পরিবর্তন করে।

যে কথাটি বলা হয়নি, তা হলো তাদের এই বনের নাম আকহাম। ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তারা তাদের বনের দখল হারাচ্ছে। আগ্রাসনের বর্তমান পর্যায়ে তারা আকহাম বনের ‘মিডল হিলস’ নামক স্থানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সেখানেই এখন তারা বসবাস করছে।      

     

তথ্যসূত্রঃ

1.Peter.J.Brown,Svea Closser,”Understanding and Applying Medical Anthropology ;Biosocial and Cultural approaches.,2016.

2.A documentary prepared by Kate Humble,titled “Living with Nomads”.(Published on July 7,2018)

3.A document prepared by Jan Moeller Hansen, titled:Nepal’s last nomadic tribe-in pictures,published by thegurdian.com,January 2017

4.See,Link:https://www.theguardian.com/global-development-professionals-network/gallery/2017/jan/20/nepals-last-nomadic-tribe-in-pictures (Accessed on January 20,2017).

5.See,BBC News,2016,”In Pictures:The Last Nomadic People of Nepal”,May 9,2016

 

 

লিখেছেন,

আকাশ মজুমদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ অনুমতি ব্যতিত লেখা আংশিক বা সম্পূর্ণ কপি করা অপরাধ। এই প্রবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব এবং আমাদের নীতিকে প্রতিফলিত করে না।

Leave a Reply