জীবনী সাহিত্যঃ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের নতুন ধারা : সৌপ্তিক রায়

জীবনী সাহিত্য বলতে আমরা কোন বিখ্যাত কারোর জীবনী, তাঁর কর্ম বা কীর্তি নিয়ে রচিত সাহিত্য কর্ম বুঝে থাকি। আধুনিক যুগের গদ্য সাহিত্যে অনেক মনীষী কিংবা বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনী নিয়ে সাহিত্য কর্ম আমরা পাই। এর মাঝে আত্মজীবনী মূলক সাহিত্য কর্মও অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনীকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনার ইতিহাস বেশ পুরোনো। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনী ও তাঁর অলৌকিক কর্মকান্ড নিয়ে রচিত কাব্যগুলোই মূলত বাংলা জীবনী সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন। শ্রীচৈতন্যদেব জীবিতাবস্থায় বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিপর্যস্ত হিন্দু সমাজে যে নবচেতনা ও আলোড়নের সৃষ্টি করেছিলেন, ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে সেই প্রভাব সেসময়ের সমাজ ও সাহিত্যে বিস্তৃত হয়ে তাঁকে চির অমর করেছে। তাঁর জীবনকথা আশ্রয় করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস মানবজীবনভূমিতে সর্বপ্রথম প্রবেশাধিকার পায়। সে সময়ের সাহিত্যে দেব-প্রাসঙ্গিক ভাবের জায়গায় নতুন মানবিক ধারার সংযোজন ঘটে। এই সাহিত্যধারাই চৈতন্যোত্তর কালের প্রধান বৈশিষ্ট্য।  

শ্রীচৈতন্যদেব ও তৎকালীন সমাজে চৈতন্য প্রভাবঃ 

শ্রীচৈতন্যদেব ১৪৮৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান ভারতের নবদ্বীপ। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচীদেবী। শ্রীচৈতন্যদেবের আদিপুরুষের নিবাস বাংলাদেশের সিলেট (তৎকালীন শ্রীহট্ট) জেলার ঢাকা দক্ষিণ গ্রামে হলেও শ্রীচৈতন্যের পিতা সিলেট থেকে নবদ্বীপে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। সে সময়ে নবদ্বীপ ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র-সংস্কৃতি, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র ছিল। চৈতন্যদেবের বাল্য নাম নিমাই, প্রকৃত নাম বিশ্বম্ভর। দেহবর্ণের জন্য তাঁকে গোরা বা গৌরাঙ্গ বলেও ডাকা হত। বাল্যকালের অতিচঞ্চল নিমাই যৌবনে সর্বাগ্রগণ্য পন্ডিত হয়ে উঠেছিলেন এবং টোল খুলে শিক্ষাদানের কাজ শুরু করেন। সন্ন্যাসপূর্বকালে তিনি ন্যায়শাস্ত্রের একটি টীকা রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই সর্প দংশনে লক্ষ্মীদেবী মারা গেলে মায়ের পীড়াপীড়িতে নিমাই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। ২৩ বছর বয়সে গয়ায় পিতৃপিন্ড দান করতে গিয়ে নিমাই বিখ্যাত বৈষ্ণবভক্ত ঈশ্বরপুরীর নিকট হতে দীক্ষা নেন। ২৪ বছর বয়সে কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ বা সংক্ষেপে ‘চৈতন্য’। তখন অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ প্রমুখ ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পুরীতে গমন করেন এবং সেখানে নীলাচলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন তীর্থে তিনি ঘুরে বেড়ান এবং বহু দার্শনিক, সাধু-সন্ন্যাসীদের সান্নিধ্যে এসে প্রেম ধর্মের বিকাশ ঘটান। এ সময়ে অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নেন। তাঁর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের বিশিষ্ট কর্মচারী সাকর মল্লিক ও দবির খাস পদে অধিষ্ঠিত রূপ ও সনাতন। জীবনের শেষ আঠার বছর তিনি কৃষ্ণপ্রেমে দিব্যভাবে বিভোর হয়ে থাকতেন। মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৫৩৩ সালে পুরীতে শ্রীচৈতন্যদেব দেহত্যাগ করেন।  

তৎকালীন সমাজ ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের দিক থেকে বিবেচনা করলে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব খুবই গুরুত্ব বহন করে। মুসলিম শাসন কালে ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণের ফলে তৎকালীন হিন্দু সমাজে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। মুসলিম শাসনামলে অনেক পীর-দরবেশের প্রভাবে অনেক হিন্দু (বিশেষ করে নিচু জাতের হিন্দু) এবং বৌদ্ধ মুসলিম ধর্মগ্রহণ করে। সেই বিপর্যয় হতে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার বীজমন্ত্র নিহিত ছিল চৈতন্যদেবের প্রচার করা বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে। চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুসারীরা এমন এক ধর্মমতের বিকাশ ঘটান যার ছায়াতলে ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে সবার আশ্রয় ছিল। মূলত জীবে দয়া ও মানবপ্রেমের আদর্শে বৈষ্ণব দর্শন ও সম্প্রদায় গড়ে উঠে। এই মানবপ্রেমের অধ্যাত্মভাব, চিত্রসৌন্দর্য ও মধুর প্রেম রসের উপর ভিত্তি করেই বৈষ্ণব সাহিত্যও গড়ে উঠে। চৈতন্যদেব ও তাঁর শিষ্যদের বিভিন্ন তীর্থদর্শনের প্রেক্ষিতে বাঙালির ভৌগোলিক সংকীর্ণতা দূর হয়ে সমগ্র ভারতের সাথে বাংলাদেশের সংযোগ ঘটে। তখন থেকেই নীলাচল, বৃন্দাবন, মথুরা বাঙালির নতুন তীর্থে পরিণত হয়। প্রেমভক্তির দিক ছাড়াও চৈতন্যদেব ইতিহাস, সমাজ ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেন। চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পরেও তাঁর পারিষদগণের মাধ্যমে সেই প্রভাব বর্তমান থাকে। ‘বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী’ নামে পরিচিত সনাতন গোস্বামী, রূপ গোস্বামী, জীব গোস্বামী, রঘুনাথ ভট্ট, রঘুনাথ দাস, গোপাল ভট্ট বৃন্দাবনে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শ্রীচৈতন্যদেবকে মুসলিম শাসনামলে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে বাংলাদেশে প্রেম ও ভাবের অপুর্ব সম্মীলন ঘটেছিল। সে সময়ের কবিদের সাহিত্যকর্মেও সেই ভাবের রসের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। 

জীবনী সাহিত্যঃ

চৈতন্যপ্রভাবেই বাংলা সাহিত্য মঙ্গলকাব্য ও নাথসাহিত্যের রহস্যময়তা হতে মুক্ত হয়ে নতুন এক ধারায় প্রবেশ করে। চৈতন্য প্রভাবের সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফল পদাবলি সাহিত্য। তাঁর প্রভাবেই বাংলা ভাষা সংস্কৃতপ্রিয় গোঁড়া ব্রাহ্মণের নিকটেও পবিত্র হয়ে উঠে। শ্রীচৈতন্যদেব জীবিতাবস্থায়ই তৎকালীন সমাজে অবতার রূপে পূজিত হতেন। তাঁর ও তাঁর কতিপয় শিষ্যের জীবন কাহিনি অবলম্বনে জীবনীসাহিত্যের সৃষ্টি হয়। চৈতন্যজীবনের বাস্তব কাহিনিতে কবিরা অলৌকিকতা আরোপ করলেও এ ধরনের বাস্তব মানুষ ও বাস্তব কাহিনি নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই প্রথম। জীবনী সাহিত্যের রচয়িতাগণের উদ্দেশ্য ছিল চৈতন্যদেবের জীবনকাহিনির মাধ্যমে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও গৌরব প্রতিষ্ঠা করা। শ্রীরাধা ও চৈতন্যদেবকে অনেকক্ষেত্রে অভিন্ন হিসেবে কল্পনা করেছেন অনেক কবি।  

কড়চাঃ 

চৈতন্যদেবের জীবনীগ্রন্থগুলোকে অনেকক্ষেত্রে ‘কড়চা’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘কড়চা’ শব্দটি এসেছে প্রাকৃত ‘কটকচ্চ’ ও সংস্কৃত ‘কৃতকৃত্য’ হতে। প্রাচীন অনুশাসনে কট শব্দটি খসড়া অর্থে পাওয়া যায়। তাই অনেকের মতে কড়চা মানে আসলে কোন রচনার খসড়া। আবার অনেকে কড়চাকে দিনপঞ্জি হিসেবেও বিবেচনা করেন। তবে চৈতন্য জীবনীকে ‘কড়চা’ বলায় কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।  

শ্রীচৈতন্যদেবের সংস্কৃত জীবনীঃ 

সংস্কৃত ভাষায় চৈতন্যদেবের জীবনীর রচয়িতা মুরারি গুপ্ত। এটিই চৈতন্যদেবের সর্বপ্রথম জীবনী গ্রন্থ। এই কাব্যের প্রকৃত নাম ‘শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম’। তবে এটি ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’ নামে বেশি পরিচিত। মুরারী গুপ্ত মূলত সিলেটের অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি চৈতন্যদেবের সহাধ্যায়ী হন। জনশ্রুতি আছে যে মুরারিগুপ্তের গৃহেই চৈতন্যদেবের প্রথম ভাবাবেশ ঘটে। তিনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক হওয়ায় বেশিরভাগ ঘটনা তিন নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর কাব্যে চৈতন্যদেবের প্রথম দিকের সন্ন্যাস পর্যন্ত বর্ণনা তিনি নিজে লিখেছেন এবং বাকিটুকু অন্যজনের রচিত। ধারণা করা হয়, এই গ্রন্থের রচনাকাল ১৫৩৩ থেকে ১৫৪২ এর মধ্যে। এছাড়া সংস্কৃতে প্রবোধানন্দ সরস্বতী ‘শ্রীচৈতন্যচন্দ্রামৃত’ নামক কাব্য রচনা করেছিলেন। 

শ্রীচৈতন্যদেবের বাংলা জীবনীঃ 

বৃন্দাবনদাসের চৈতন্যভাগবতঃ বাংলা ভাষায় শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনী সর্বপ্রথম রচনা করেন বৃন্দাবনদাস। তাঁর রচিত কাব্যের নাম ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’। এই কাব্য প্রথমে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে পরিচিত হলেও, ভাগবতের প্রভাব ও লীলা পর্যায় দেখে এর নাম ‘চৈতন্যভাগবত’ রাখা হয়। বৃন্দাবনদাসের জন্ম আনুমানিক ১৫১৮ সাল এবং কাব্যটির রচনাকাল ১৫৪৮ সাল। কবি তাঁর গুরু নিত্যানন্দের কাছ থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন। বৃন্দাবনদাস তাঁর কাব্যে শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দকে কৃষ্ণ ও বলরামের অবতার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বৈষ্ণবভক্তের বাইরের সমাজের কাছেও এই কাব্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ এই কাব্যে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক, রাজনৈতিক অবস্থা, শাসকের সাংস্কৃতিক প্রভাব, লৌকিক ধর্মাচার, শাস্ত্রাচার, ব্রাহ্মণদের নীতিশিথিলতা, হিন্দু-মুসলমান সপর্ক, বৈষ্ণব উপমত প্রভৃতি জীবনচিত্র খুব সুচারুরূপে বিধৃত হয়েছে। কবির তথ্যনিষ্ঠ বর্ণনা আর বিশ্বাসনিষ্ঠ আন্তরিকতায় ‘চৈতন্যভাগবত’ হয়ে উঠেছে এক অনন্য কাব্য। তাই বৃন্দাবনদাসকে চৈতন্যলীলার ব্যাস বলা হয়। 

লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গলঃ এই কাব্যটির রচনাকাল ১৫৫০ থেকে ১৫৫৬ সালের মধ্যে বলে অনুমান করা যায়। কবি লোচনদাস তাঁর গুরু বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নেতা নরহরি সরকারের আদেশে এই কাব্য রচনা করেন। এর রচনাধারা অনেকাংশে মঙ্গলকাব্যের অনুরূপ। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ‘গৌরনাগর’ শাখার মতাদর্শ ও সাধন প্রণালী এই কাব্যের উপজীব্য। কাব্যটিতে ইতিহাসের ঘটনার যথার্থতা সম্পর্কে কিছু ত্রুটি থাকলেও ভক্তহৃদয়ের ঐতিহ্য ও ভাব এতে ক্ষুণ্ন হয়নি। এ কাব্য রচনায় কবি মুরারি গুপ্তের কড়চার সাহায্য নিয়েছিলেন। 

জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলঃ কবি জয়ানন্দের জন্ম ১৫১৩ সালে, বর্ধমান জেলায়। সম্ভবত ১৫৬০ সালের দিকে এই কাব্যটিতে তিনি রচনা করেন। এ কাব্যের প্রধান ত্রুটি হচ্ছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে অমিল। কাব্যটি মূলত মঙ্গলকাব্য ও পৌরাণিক ধাঁচের রচনা। ঐতিহাসিক তথ্যের সাথে অনৈক্য এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বের অনুপস্থিতির কারণে এ কাব্য বৈষ্ণব সমাজে খুব বেশি সমাদৃত হয়নি। 

কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতঃ কবির জন্ম ১৫২৭ সালে বর্ধমান জেলায়। চৈতন্যসহচর নিত্যানন্দ কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কবি বৃন্দাবনে আসেন। সেখানে তিনি রূপ, সনাতন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের সাহচর্য পান এবং তাঁদের সহায়তায় যাবতীয় ভক্তিশাস্ত্র ও বৈষ্ণব সাহিত্য অধ্যয় করতে থাকেন। বৃন্দাবনে বৈষ্ণব আচার্য ও গুরুদের অনুরোধে ১৬১৫ সালে বৃদ্ধাবস্থায় কবি ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যটি রচনা করেন। এছাড়া কবি তাঁর প্রথম জীবনে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক ‘গোবিন্দলীলামৃত’ নামক এক সংস্কৃত কাব্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বৈষ্ণব জীবনী সাহিত্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যটিই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় এবং শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। 

গোবিন্দদাসের কড়চাঃ এই কাব্যটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিতর্কিত গ্রন্থ। কাব্যটির মূল উপজীব্য চৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ও পশ্চিম ভারত পরিভ্রমণের কাহিনি। ১৮৯৫ সালে জয়গোপাল গোস্বামী এই কাব্যটি প্রকাশ করেন। কাব্যটিকে অনেকেই পুরোপুরি জাল বলেছেন। অনেকের মতে কড়চার আগাগোড়া পুরোটাই জয়গোপাল গোস্বামীর কল্পনাপ্রসূত।   

চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গবিজয়ঃ এই কাব্যের প্রকাশক ড. সুকুমার সেন। কাব্যটির আরেক নাম ‘ভুবনমঙ্গল’। খন্ডিত এই কাব্যটিও বৈষ্ণব সমাজে মোটেই সমাদর পায়নি। এই কাব্যে চৈতন্যদেবের জীবন কাহিনিতে অনেক ভুলভ্রান্তিও বিদ্যমান।  

অন্যান্য গ্রন্থঃ

চৈতন্যদেবের জীবনী ছাড়াও তাঁর কয়েকজন শিষ্য ও সহচরদের জীবনী নিয়েও কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে। এঁদের মধ্যে অন্যতম অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ, হরিদাস প্রমুখ। 

  • শ্রীহট্ট লাউড়ের রাজা দিব্যসিংহ অদ্বৈতের শিষ্য হয়ে সন্ন্যাস গ্রহন করে এবং তাঁর নাম হয় কৃষ্ণদাস। অদ্বৈতের বাল্যলীলা অবলম্বনে তিনি সংস্কৃতে ‘বাল্যলীলাসূত্র’ গ্রন্থটি রচনা করেন। পরে শ্যামানন্দ তা বাংলায় অনুবাদ করেন এবং নাম দেন ‘অদ্বৈততত্ত্ব’। –
  • বাংলায় ঈশান নাগরের লেখা অদ্বৈত জীবনী ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ প্রকাশিত হয় ১৫৬৮-৬৯ সালে। এছাড়া হরিচরণদাসের ‘অদ্বৈতমঙ্গল’ কাব্যটিও উল্লেখযোগ্য। 
  • এছাড়া চৈতন্যশিষ্য শ্রীনিবাস ও নরোত্তমের জীবনী অবলম্বনেও কাব্য রচিত হয়। গুরুচরণ দাসের ‘প্রেমামৃত’ মূলত শ্রীনিবাসজীবনী। 

সতের শতকের দিকেই জীবনী সাহিত্য রচনা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পরে। এই সময়ের রচিত কাব্যগুলো বৈষ্ণব আন্দোলনের গ্রন্থ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলোর সাহিত্যমূল্য খুবই অল্প। 

প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নঃ 

  • চৈতন্যদেবের জীবনভিত্তিক কাহিনিকাব্য প্রথম রচনা করেন – বৃন্দাবনদাস
  • একটি বাংলা পঙক্তি না লিখলেও যাঁর নামে বাংলা সাহিত্যে একটি যুগের সৃষ্টি হয় – শ্রীচৈতন্যদেব। 
  • চৈতন্যদেব বিখ্যাত – বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারক হিসেবে। 
  • চৈতন্যজীবনীকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি – কৃষ্ণদাস কবিরাজ। 
  • বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে যে ধর্মপ্রচারকের প্রভাব অপরিসীম – শ্রীচৈতন্যদেব। 

লিখেছেন 

সৌপ্তিক রায়

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় 

Leave a Reply