You are currently viewing বাংলা সাহিত্যে নারীর ক্ষমতায়ণ ও বাস্তবতা – নাজমুন নাহার

বাংলা সাহিত্যে নারীর ক্ষমতায়ণ ও বাস্তবতা – নাজমুন নাহার

  • Post category:Chapakhana

মেয়েরা একটি শক্তি। সে যাই করুক সৃষ্টি কিংবা ধ্বংস, মেয়েরা চিরকাল রহস্যময়ই থেকে যাবে। কখনো সে মা কখনো সে আদর্শ গৃহিণী। একই অঙ্গে শত রূপ। সেই রুপ বা আদর্শ সমাজে লালিত পালিত। মেয়েদের পক্ষে এই আদর্শের বাইরে যাওয়া কঠিন। তারা সমাজের সবচেয়ে অনুগত সামাজিক প্রাণী। বিয়ের পরই তারা স্বামীর সম্পত্তি হয়ে যায়। পরিবেশই তখন তাদের বলে দেয় কল্পনা বিলাস তোমাদের সাজে না, এটা শুধুমাত্র পুরুষের অধিকার। সেই আদিকাল থেকে সমাজে এই ধারণা প্রচলিত। তবে বাংলা সাহিত্যে নানা সময়ে নারী চরিত্রের মাধ্যমে প্রথা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসাকে আমরা দেখতে পাই।

সাহিত্যগুলো সমাজের উপর কতটুকু প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে সেটি বিতর্কের বিষয়। বিভিন্ন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন রকমের হয়। তারমধ্যে সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ গুরুত্ব পায়। একজন সাহিত্যিকই পারেন সমাজের সকল অবিচারের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথ বের করতে।

নারীরা সমাজের সবচেয়ে অবদমিত প্রাণী। সেই জায়গা থেকে একটু ভিন্ন ভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নারী অধিকারের কথা বলেছেন। সেই সাথে ভবিষ্যতের একটি রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের বিনোদিনী দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। যে কিনা অল্প বয়সে বৈধব্য লাভ করে। কিন্তু তবুও সে শিক্ষিতা, অপরূপা, রুচিসম্পন্না, সংস্কারমুক্ত আধুনিক নারী। মানব জীবনের কঠিন সংস্পের সন্ধান পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। গল্পের ভেতর থেকে ধেয়ে এসে জেগে ওঠে মায়ের ঈর্ষা। সেই ঈর্ষা মহেন্দের রিপুকে ‘কুৎসিত অবকাশ’ দিয়েছে। নাহলে এভাবে হয়তো দাত নখ বেরিয়ে পরতো না। সেখান থেকে বিনোদিনী তার বৈধব্যের লড়াই করেছে দৃঢ়তার সাথে ভালোবাসার জন্য।

একজন বিবাহিতা নিঃসঙ্গ নারীর জীবনধারা ফুটিয়েছেন ‘নষ্টনীড়ের’ চারুলতার মাধ্যমে। স্বামীর কাছ থেকে অবজ্ঞা পেতে পেতে আকৃষ্ট হয় তারই সমবয়সী দেবরের প্রতি। আকর্ষণ দূর্নীবার হওয়ার পর স্বামী যখন নতুন করে তার জীবনের সূচনা করার কথা বলে তখন সে ফিরিয়ে দেয় এই প্রস্তাব। স্বামীর সঙ্গেই ঘর করতে থেকে সে। নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য দেখায় দৃঢ়তা।

উচ্ছ্বল একটি মেয়ের গল্প উঠে এসেছে ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ীর মাধ্যমে। যে কিনা সমাজের কাছে প্রশ্ন রেখেছে কেন শুধুমাত্র নারীকেই সকল কিছু মানিয়ে নিতে হবে।  

‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে মৃণাল সাংসারিক জীবনে সুখ না পেয়ে ঘর ছেড়েছে। প্রথা ভেঙ্গে পুরুষতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখাতে সাহস করেছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার আরো একটি বড় উদাহরণ ‘যোগাযোগ’ গল্পের কুমু।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আরেক প্রবাদ পুরুষ হলেন শরৎচন্দ্র। তিনি অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সমকালীন সমাজকে আঘাত করেছেন। ভাঙতে চেয়েছেন সমাজের অশুভ অপসংস্কারকে। যা কিনা মানুষকে মানুষের মর্যাদায় দাঁড়াতে দেয় না। তার সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলো প্রতিটি গল্পের নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে রাজলক্ষ্ণী সমাজের প্রচলিত নারী চরিত্র থেকে ভিন্ন। তখনকার সময়ে দাড়িয়েও পবিত্র এক প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো শ্রীকান্তের সাথে। এজন্য সমাজ তাকে কি বলছে তার বিন্দু মাত্র ধার ধারে নি সে।

‘গৃহদাহের’ অচলা চরিত্র তার স্বমহিমায় গল্পের আবহ তৈরি করে এবং আপন মর্যাদায় নিজের অবস্থানকে মজবুত করে। যা কিনা মহিম ও সুরেশের আন্তঃ দ্বন্দে একটুও ম্লান হয়নি।

‘দত্তার’ বিজয়া এক অসাধারণ সাহসী, স্পষ্টভাষী এবং অনমনীয় ব্যক্তিত্বের ধারক। যেকিনা পিতৃহীনা হয়েও ভেঙ্গে পরেনি। ভালোবাসার জন্য প্রথা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে।

‘দেবদাস’ উপন্যাসের পার্বতী প্রেমিকা হিসেবে যেমন সাহসী ছিলো তেমনিভাবেই একজন গৃহিনী হিসেবে নিপুনা ছিলো। সংসারে আবদ্ধ থেকেও প্রথম প্রেমের কথা অস্বীকার করে নি।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীকে তার প্রাপ্য স্বাধীনতা ও অধিকার দিতে এতোটুকু কার্পণ্য করেন নি। কবিতায় বা গল্পের অঙ্গনে তার সৃষ্ট নারীরা লক্ষ্মী প্রতিমার আদলে দীপ্যমান হয়েছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তার ‘নারী’ কবিতাটি। সেখানে তিনি নারী পুরুষের সমানাধীকারের বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন।

‘বাধনহারার’ নায়িকা মাহবুবার ক্ষোভ যেমন সমাজের প্রতি তেমনি শিক্ষিত পুরুষজাতির প্রতিও। যারা মেয়েদের যথার্থ সম্মান দিতে কুন্ঠা বোধ করে।  

‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বেশ কয়েকটি শক্তিশালী চরিত্র এনেছেন যাদের মধ্যে জামিলা অন্যতম। মজিদের সাধের মাজার যার মাধ্যমে সে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছে সেখানে জমিলা নগ্ন পায়ে আঘাত করেছে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জামিলা সমাজে পরিবর্তন আনতে চেয়েছে।

জহির রায়হানীর বহুল জনপ্রিয় উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ যেখানে তিনি টুনির জীবনের উত্থান পতনকে তুলে এনেছেন। ১৪ বছরের টুনির সাথে বৃদ্ধ মকবুলের বিয়ে হয়। কিন্তু সে তার স্বপ্ন নৌকাটি পায় মন্তুর কাছে। যদিও সামাজবিরোধী তবুও সে স্বপ্ন দেখে মন্তুর সাথে ঘর বাধার। টুনির পরিণতি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। শেষ পর্যন্ত শূন্য হাতে বাপের বাড়ি যায় সে। কিন্তু তবুও শৃঙ্খল ভাঙ্গে নি।

মানিক বন্দোপাধ্যায় তার ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে ২৩ বছরের বাজা কুসুমকে উঠিয়ে এনেছেন। সে অস্থির এবং বেপোরোয়া। একই সাথে যার কাছে দেহ ও মনের দাবি সমানভাবে মূল্যবান। তার এই আকাঙ্খার জন্য প্রচলিত সংস্কারকে ভাঙতেও পিছপা হয়নি সে। তাই সে সমস্ত দ্বিধাকে অস্বীকার করে শশীর কাছে আশ্রয় চায়। কিন্তু তার নিস্পৃহতা আর নিষ্ক্রিয়তা কুসুমকে আশাহত করে। সমস্ত কিছু ভুলে যখন সে সংসারে মগ্ন তখন শশী ফিরে আসে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দৃঢ়তার সাথে কুসুম জানিয়ে দেয় যে শশীর সুবিধা মত কুসুমের মন চলে না।

যুগে যুগে নারীর এই সাহসীকতাকে বিভিন্ন সাহিত্যিক বিভিন্নভাবে এনেছেন। কিন্তু তবুও নারীরা অবদমিত। ঠিক কিভাবে? একটু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ বুলাই।

বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ১২ মিলিয়ন শিশু ‘বাল্য বিবাহের’ শিকার হয় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল- ইউনিসেফ(রিপোর্ট ২০১৮)। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৩৬ জন নারীকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৯৫ জন নারী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। 

যেখানে আমরা সাহিত্যে নারীকে দেখি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছে ঠিক সেখানেই দেখি আমরা জোর করে বাল্যবিবাহ। যেখানে সমাজের সকলকে পেছনে ফেলে সংসারের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেড়িয়ে এসেছে নারী ঠিক সেখানেই আমরা দেখি যৌতুকের জন্য খুন কিংবা আত্মহত্যা। টুনির মন যখন মন্তুর নায়ে ঘুড়ে বেড়ায় সেখানে আমাদের পুরুষতান্ত্রিকতার জোরের উপর মন পিঞ্জিরায় আবদ্ধ থাকে। যেখানে না বলে দৃড় চিত্তে সব ফেলে আত্মসম্মান নিয়ে সাহিত্যে নারী বাঁচে সেখানে আমাদের নারী ধুঁকে ধুঁকে মরে স্বামীর ঘরে। আমাদের বিধবাকে যেখানে অশুভ গণ্য করা হয় সাহিত্যে সে রুচিসম্পন্না হয়ে দাপটে ঘুরে বেড়ায়। ধর্মের ব্যাপারে যেখানে আমরা স্পর্শকাতর সেখানে জামিলা জীবন দিয়ে সেই কুসংস্কারকে মাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজে এই যখন হয় নারীর অবস্থান তখন শৃঙ্খলা, প্রথা, পুরুষতান্ত্রিকতা ছেড়ে বেরিয়ে আসা একটি অসম্ভব উপায়। সাহিত্যিক যখন নারীকে সম্মানে, সাহসে, বুদ্ধিতে, শ্রদ্ধায় আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন ঠিক তখন ই বাস্তবে এই সমাজ তাকে পায়ের নিচে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।

Leave a Reply