You are currently viewing রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ : সানজিদা রশীদ

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ : সানজিদা রশীদ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত সমস্যা। কেন এই যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী এর কি প্রভাব পড়ছে, এর পরিণতিই বা কি? সেইসব জানার আগে ছোট করে জেনে নেয়া যাক রাশিয়া ও ইউক্রেনের পরিচিতি।

রাশিয়া-ইউক্রেন পরিচিতি : আয়তনে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ এবং ইউরোপের বৃহত্তম রাষ্ট্র রাশিয়া। ১,৭০,৭৫,৪০০ বর্গ কি.মি. আয়তনের এ দেশটির রাজধানী মস্কো দেশটির বৃহত্তম শহর। ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশ জুড়ে রাশিয়ার অবস্থান। দেশটির মোট ভূখণ্ডের ৪০ শতাংশ এবং ৬০ শতাংশ পড়েছে যথাক্রমে ইউরোপ মহাদেশ এবং এশিয়া মহাদেশের মধ্যে। তবে আয়তনের তুলনায় রাশিয়ার জনসংখ্যা অত্যন্ত কম। প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৮ জন্য করে লোক বাস করে এ দেশে। জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বে নবম স্থানে রয়েছে রাশিয়া। নবম শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় রাশিয়াতে। সে সময় রুশ নামে ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিলো রাশিয়া। ১৭২১ সালে রুশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একের পর এক এলাকা বিজয় করে এর পরিধি বাড়াতে থাকেন রুশ শাসকরা। সেই সাম্রাজ্য টিকে ছিলো ২০০ বছর। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

আর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টি নতুন প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়। ওই বছর ১২ ডিসেম্বর জন্ম নেয় রুশ ফেডারেশ বা রাশিয়ান ফেডারেশন। অন্যদিকে ওই বছরেই ২৪ আগস্ট জন্ম নেয় ইউক্রেন রাষ্ট্র। রাশিয়ার পরে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র ইউক্রেন। দেশটির আয়তন ৬,০৩,৭০০ বর্গ কি.মি.। এটি পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। কিয়েভ এ দেশের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে ১৫ টি নতুন প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয় ইউক্রেন তার মধ্যে অন্যতম। ১৯৯১ সালের ২৪ আগস্ট দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। ইউক্রেন খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। এর অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই উন্নত এছাড়াও দেশটির কৃষি ও শিল্পখাত উল্লেখযোগ্য হারে সমৃদ্ধ।

২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২(বৃহস্পতিবার), রুশ স্থানীয় সময় সকাল ছয়টায় ইউক্রেনে একটি বড় আকারের আক্রমণ করে রাশিয়া। ধারণা করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই প্রথম কোনো দেশের সশস্ত্রবাহিনী স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথে অন্য একটি দেশকে এভাবে আক্রমণ করেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই এই যুদ্ধের ঘোষণা দেন।
কিন্তু কেন এই যুদ্ধ?


মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্বই এই যুদ্ধের প্রধান প্রভাবক। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের জের ধরেই এ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ১৭৮৩ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট নিকিতা খ্রুশ্চভ স্বেচ্ছায় ‘উপহার’ হিসেবে রুশ ভাষাভাষী ক্রিমিয়ার দখল ইউক্রেনের কাছে ছেড়ে দেন। রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী ইউরোপীয় দেশগুলো নিয়ে গড়ে ওঠা সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে গেলে ক্রিমিয়ার ওপর থেকে সম্পূর্ণরূপে দখল হারায় রাশিয়া। এরপর থেকেই ধীরেধীরে জন্ম নেয় রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে রাশিয়া অবৈধভাবে ক্রিমিয়া দখলের পর এ দ্বন্দ্ব যুদ্ধে রূপ নিতে শুরু করে। তবে বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মূল কারণ ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্যভুক্তি হওয়ার প্রচেষ্ঠা। North Atlantic Treaty Organization বা NATO ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থা যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে ন্যাটো প্রভাব বিস্তার শুরু করে।


বর্তমানে ৩০ টি দেশ এই জোটের সদস্য। সাম্প্রতিককালে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশেই ন্যাটোর প্রভাব লক্ষণীয়। ন্যাটোর এমন একচেটিয়া রাজত্ব স্বভাবতই রাশিয়াকে অস্বস্তিতে ফেলছে। ন্যাটোর প্রভাব যতই রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছে ততই রাশিয়ার দুশ্চিন্তা বেড়ে উঠছে। এরমধ্যে ইউক্রেন’এর ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আগ্রহ রাশিয়ার কাটা ঘায়ে যেন নুন ছিটিয়ে দিলো। সহজ কথায় ইউক্রেন যদি ন্যাটোর জোটভুক্ত হয়ে যায় রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর থেকে সমস্ত দাপট্য হারাবে এবং ন্যাটোর প্রভাব বিস্তার আরো বাড়বে যা ইউরোপে বাড়াবে পশ্চিমাদের জোর এবং যা রাশিয়ার মোটেই কাম্য নয়। আর এজন্যই ইউক্রেনের সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে নামে রাশিয়া। পুতিনের দাবি ছিলো যে, আধুনিক ও পশ্চিম-ঘনিষ্ঠ ইউক্রেন রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিশ্বে এ যুদ্ধের কি প্রভাব পড়ছে?


ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণের জবাব হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলো শুরু থেকেই বেছে নেয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমদানি-রপ্তানী কার্জকমে ভাটা পড়েছে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে গেছে অভাবনীয়রূপে। দেশে দেশে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ, ভুট্টা ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১ ও ৫.৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট হওয়ার আশংকা করছেন। রাশিয়ার ওপর এই নিষেধাজ্ঞায় প্রথম এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারপর একে একে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ আরো পশ্চিমা রাষ্ট্র যুক্ত হয় এই প্রক্রিয়ায়।

এখনো পর্যন্ত যেসকল নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর আরোপ করা হয়েছে সেগুলো হলোঃ
 SWIFT(The Society for Worldwide Interbank Financial Telecommunication) থেকে রাশিয়ান ব্যাংকগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, রাশিয়ার ৬টি ব্যাংক SWIFT এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
 রাশিয়ার যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
 পশ্চিমা দেশগুলোতে রাশিয়ার বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে।
 রাশিয়ার সাথে রপ্তানী বাণিজ্য(বিশেষ করে উচ্চ প্রযুক্তিগত পণ্য এবং কেমিক্যাল পণ্য রপ্তানী) বন্ধ করা হয়েছে।
 পশ্চিমা দেশগুলোই অবস্থিত রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে থাকা ৬৩০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ জব্দ করা হয়েছে।
 রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন স্থগিত করা হয়েছে।


নিষেধাজ্ঞার শুরুতেই অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায় রাশিয়াতে। নিষেধাজ্ঞার দুইদিনে ডলারের বিপরীতে রাশিয়ান কারেন্সি রুবলের দরপতন ঘটে প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে পরবর্তীতে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে; যেমন- রপ্তানীকারক কোম্পানীগুলোকে বিদেশী ডলার পাঠাতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, কোম্পানীগুলোকে তাদের ফরেন রিজার্ভের ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করে রুবল কেনার আদেশ প্রদানসহ সুদহার দ্বিগুণ করা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে অনেকটায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে রাশিয়া।
অন্যদিকে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক সংকট মূল্যস্ফীতি বাড়াচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়াতে পারে যা ১৯৮১ সালের পর সর্বোচ্চ এবং বিশ্বব্যাপী তা বাড়তে পারে প্রায় ৭ শতাংশ। তাছাড়া জ্বালানী তেলের ক্রমবর্ধমান মূল্য বিশ্ববাজারে অসামঞ্জস্য তৈরী করছে। তেলের বাজারের অস্থিরতা বিশ্বব্যাপি জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে প্রায় ১ শতাংশ। তেল, গ্যাসসহ খাদ্যপণ্যের সরবরাহ তথা বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিশ্ববাসী।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট শুধু দেশ দুটির ওপরই প্রভাব ফেলছে না, পশ্চিমা দেশগুলোসহ পুরো বিশ্বেই এর প্রভাব লক্ষণীয়।
যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা কেমন?


দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও অব্যাহত রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মস্কো-কিয়েভ সংঘর্ষ এখনো চলমান। তবে রুশবাহিনী ধীরেধীরে পিছু হটতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। বেশকিছু ফ্রন্টে তারা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে শুরু করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো একজোট হয়ে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার একচ্ছত্র আগ্রাসনের মোকাবেলা করতে। গতকাল, ২৪ মার্চ, বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৪ দিনের সফরে ইউরোপ পৌঁছেছেন। রুশ হামলা মোকাবেলায় ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করা, ইউক্রেনকে সর্বোচ্চ সমর্থন প্রদান এবং রাশিয়ার ওপর নতুনভাবে চাপ তৈরী করার উদ্দেশ্যেই এই সফর। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা নীতি অবলম্বনই চলমান যুদ্ধ বন্ধের সর্বোত্তম পন্থা হতে পারে।

লিখেছেন: সানজিদা রশীদ,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply