You are currently viewing কিছু রবীন্দ্রসংগীতঃ প্রেম? নাকি আধ্যাত্মিকতা? – সৌপ্তিক রায়

কিছু রবীন্দ্রসংগীতঃ প্রেম? নাকি আধ্যাত্মিকতা? – সৌপ্তিক রায়

  • Post category:Chapakhana

১.

একটা ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করি। সময়টা ২০১৪ বা ১৫। কলেজের প্রথম বর্ষের সোনালী দিনগুলো কাটাচ্ছি আমি। গোপীবাগ রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ বিদ্যার্থীভবনে থাকতাম। সেখান থেকে নটরডেম কলেজ খুব কাছেই। হেঁটে যাওয়া আসা করতাম মোটামুটি সবাই। সেই সময় ছাত্রাবাসে মোবাইল রাখা নিষিদ্ধ। যে দুয়েকজন লুকিয়ে চুরিয়ে নিজের কাছে মোবাইল রাখতো তাদের কাছ থেকে আমরা ফোন নিয়ে বাসায় ফোন করতাম। তো সেই সময়ে ছাত্রাবাসের দুয়েকজনের ফোনে অর্ণবের গলায় “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই” গানটা শুনি। রবীন্দ্রসঙ্গীত। অর্ণবের রিএরেঞ্জমেন্টে গাওয়া। আগেই বলে রাখি আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডাই হার্ড ফ্যান, মানে ঠিক ফ্যান না বরং অন্ধভক্ত টাইপ। অনেক মানুষ যেমন নিজের ধর্মের কোনো সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, আমি রবীন্দ্র সঙ্গীতের সমালোচনা সহ্য করতে পারি না। কেন যেন আমার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত মানেই স্বর্গীয় কিছু অনুভূতি!

 

যাই হোক অর্ণবের গলায় ঐ গান শুনে আমি পুরো বিমোহিত। প্রচন্ড ভাবে দিনরাত ওইগান শুনে চলেছি তখন। যেহেতু কাছে মোবাইল থাকতো না, সেই অভাবটা পূরণ করেছি নিজের মনে গুণগুণিয়ে। তো গানটা নিয়ে অধিক চর্চা করার ফলেই কি না কে জানে, কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হলো আমার মনে। একদিন সকালে কলেজ যাওয়ার সময় বন্ধু @Aditya Sarker কে জিজ্ঞেস করলাম এই গানটা নিয়ে ওর কি মত? বলাবাহুল্য আমার মতো এই ছেলেও এই গানটা প্রচন্ড পছন্দ করতো। ওর কাছে জিজ্ঞেস করলাম রবি ঠাকুর এই গানটায় আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন?

 

“ওহে কি করিলে বলো পাইবো তোমারে

রাখিবো আঁখিতে আঁখিতে? “

 

এইখানে যে “তুমি”, সেই “তুমি” আসলে কে?

কার প্রতি প্রেম? মানুষ? নাকি ঈশ্বর?

এই গানটা কি আসলে আমরা প্রচলিত ভাবে যে প্রেম বুঝে থাকি, সেই প্রেম? নাকি আধ্যাত্মিক প্রেম? ঈশ্বরের প্রতি প্রেম?

আদিত্য ওর মতামত দিলো, এটা আসলে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম। মিলে গেল কথাটা আমার মনের সাথে। আমি যেভাবে ভাবলাম, আমার বন্ধুও সেভাবে ভেবেছে। আসলে তখন কলেজে পড়তাম, ছোটই ছিলাম বলা চলে। চিন্তা ভাবনা তখনো এতো বিকশিত হয়নি ভালো করে। তাই নিজের চিন্তার সাথে আরেকজনের সাপোর্ট পেলে নিজেকে কনফিডেন্ট লাগতো। ভালো লাগলো ওর চিন্তার সাপোর্ট পেয়ে। মন দিয়ে গানটা আবার যখন শুনলাম, আমার মনে এই গানটার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল কয়েক গুণ। প্রতিটা লাইনে, প্রতিটা কথায় আমি ঈশ্বর বন্দনা খুঁজে পেলাম খুব ভালো করে। প্রতিটি লাইনের “তুমি” তে আমি কোনো “প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের নিবেদন” কল্পনা না করে কল্পনা করতে থাকলাম “ঈশ্বরের প্রতি ভক্তের নিবেদন” কে। একটা মিস্ট্রি সলভ করে উঠলে একজন গোয়েন্দা যেমন আনন্দ পায় আমার মনে তখন সেই আনন্দের সুবাতাস বইতে শুরু করলো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি দ্বার উন্মুক্ত হলো আমার কাছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসার পারদও অনেক উঁচুতে উঠে গেল।

 

২.

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে খুব একটা জনপ্রিয় প্রশ্ন হচ্ছে,  তাঁর সমসাময়িক শরৎচন্দ্র কথাসাহিত্যে বা নজরুল কবিতায়  বেশি জনপ্রিয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষা। এমনকি আমি নিজেও রবিঠাকুরের কথাসাহিত্য পড়ে খুব একটা আবেগ পাইনি, যেটা পেয়েছি শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়ে। তাহলে প্রশ্ন আসে রবিঠাকুর কেন বিশেষ? এই প্রশ্নটার উত্তর দিয়েছেন নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। উনার পরিচালিত রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর ভিত্তি করে বানানো সিরিয়াল “গানের ওপারে” তে তিনি একটি চরিত্র কে দিয়ে বলিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের বিশেষত্ব তাঁর গান। রবীন্দ্রনাথের মতো এত বিশাল সংখ্যার গান আর কোনো কবি লিখেননি৷ হয়তো অদূর ভবিষ্যতে লিখবেনও না। আবার তাঁর গান শুধু সংখ্যার বিচারেই অধিক নয়, বরং প্রতিটা গানের মাহাত্ম্য অন্যরকম।

প্রতিটি গানই স্বমহিমায় উজ্জ্বল আসলে।

যাক এবার টপিকে আসি। প্রথম ভাগে যেমন বললাম, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি টান বাড়তেই থাকলো আস্তে আস্তে আমার। আগে শুধু গান শুনতাম। কিন্তু গানের কথার অর্থ তলিয়ে অনুধাবন করতাম না কখনো। কলেজ লাইফের সেই ঘটনাটার পর একটা রোখ চাপলো নিজের মাঝে, এখন থেকে যে রবীন্দ্রসংগীতই শুনবো সেটা মন দিয়ে শুনে সেই গানটার গূঢ় অর্থ বের করবো আমি। যা ভাবা সেই কাজ। শুরু হলো সেই মোটিভ নিয়ে গান শোনা। আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম, এমন কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে যেগুলো শুনলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে পুরো রোমান্টিক গান। কিন্তু একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই বুঝা যায় সেই রোমান্টিক গানটা রোমান্টিক হলেও সেই গান কোনো জাগতিক প্রেমের কথা বলে না। বলে আধ্যাত্মিক প্রেমের কথা। “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই” এর কথা তো আগেই বললাম। আরও দুয়েকটা উদাহরণ দেই।

আমাদের খুব পরিচিত একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত হলো “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে”। গানটি শুনলে পারতপক্ষে মনে হবে একটু বিরহ একটু প্রেম নিয়ে গানের গল্পটা তৈরি। আমার প্রিয়জনকে আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু সে আমার কাছেই ছিল। আমার হৃদয়ের মাঝেই ছিল। আমি আমার হৃদয়পানে চাইনি বলে তাকে হারিয়েছি। কিন্তু আসলেই কি তাই? এখানে এই হিয়ার মাঝে বাস করে যে জন, সে কি আসলে আমার মনের মানুষ? একটু যদি চিন্তা করি আমরা, বুঝবো আসলে এই হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকার জন হচ্ছে পরমেশ্বর, সৃষ্টিকর্তা, ভগবান, গড, আল্লাহ। অথবা একটু অন্য কথায় যদি বলি, বিবেক। আমি তাঁকে খুঁজে বেড়িয়েছি।  বাহির পানে। জগতের সব জায়গায়। অথচ আমাদের সবচেয়ে কাছের জায়গা গুলোতেই তাঁর বসবাস। আমাদের সকল ভালোবাসা, সকল আশায় তাঁরই বিচরণ। তিনিই সেই সর্বেশ্বর। তাঁকে বাইরে খুঁজতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার নিজের মাঝেই উনি সুন্দর ভাবে বিরাজ করছেন।

রবীন্দ্রনাথের এই গানটার গূঢ় কথা অনেকাংশে বাউল ধর্মের মতবাদগুলোর একটির সাথে মিলে যায়। মিলে যায় বাউলদের “মনের মানুষ” তত্ত্বের সাথে, সেই অধ্যাত্মবাদের সাথে।

এবার আসা যাক অন্য একটি গানের প্রসঙ্গে।

 

“তোমারেই করিয়াছি

জীবনেরও ধ্রুবতারা-

এ সমুদ্রে আর কভু

হবো নাকো পথ হারা।”

 

নিরেট নিখাদ রোমান্টিক গান বলেই মনে হয়। মনে হয় কোনো এক প্রেমিকার প্রতি তার প্রেমিকের কাতর স্বীকারোক্তির গান এটি। হ্যাঁ, এমন ভাবতে ক্ষতি নেই। কিন্তু তার পাশাপাশি এই গানটিও কিন্তু আধ্যাত্মিক। প্রতিটা ‘তুমি’ যদি আমরা ‘ঈশ্বর’ দ্বারা রিপ্লেস করি, খুব সুন্দর অর্থ দাঁড়ায়। অর্থ দাঁড়ায় এমন –

“আমি তোমাকেই (ঈশ্বর,সৃষ্টিকর্তা) জীবনের ধ্রুবতারা করেছি। আমি যেখানেই যাই না কেন, আমার  মাঝে তুমি প্রকাশমান। আমার নয়নজলে তুমিই কিরণধারা ঢালো। যদি কখনো আমার মন বিপথে যেতে চায়, তোমার মুখ মনে করেই আমি লজ্জায় অবনত হই।”

এই তুমি পরম করুণাময় ছাড়া আর কে হবে!

৩.

রবীন্দ্রনাথের বহু গানে এমন আধ্যাত্মিকতা আমরা দেখতে পাই “আমি বহু বাসনায়”, ” নয়নও তোমারে পায় না দেখিতে”, “আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন”, 

“হিমেরও রাতের ঐ গগনের দীপগুলিরে”, ” কবে আমি বাহির হলেম” ইত্যাদি। এই গানগুলিকে আমরা সাধারণত প্রেম বা বিরহের গান ভেবে ভুল করি হয়তো। আমার মতে গানগুলো অবশ্যই প্রেমের গান। তবে হয়তো এর দ্বারা ঈশ্বরকেও ডাকা সম্ভব। একটু চিন্তা করলে, সৃষ্টিকর্তার গুণকীর্তন করা সম্ভব এই গানগুলো দিয়ে।

রবীন্দ্রনাথ আসলে আকাশের মতো বিশাল। জলের মতো স্বচ্ছ। আবার ধোঁয়ার মতো ধূসর। মন দিয়ে দেখতে পারলে হয়তো উনার প্রতিটা সৃষ্টিতে এমন কিছু পাওয়া সম্ভব যেখান থেকে পাঠক বা শ্রোতা পৌঁছে যাবেন অন্য একটি বিশ্বের দোরগোড়ায়। হয়তো উন্মোচিত হবে নতুন একটি মঞ্চ, নতুন একটি রূপ।

যে রূপে উনার সৃষ্টিগুলো হয়তো ধরা পরবে অন্য একটি মূর্তিতে।

অবাক হয়ে লক্ষ্য করি কিছু মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নাস্তিক  বানাতে উঠে পরে লাগেন। কিন্তু উনি নাস্তিক নন। বরং উনি প্রচন্ড রকমের আস্তিক। বিশ্বাস করতেন প্রকৃতিতে। বিশ্বাস করতেন আধ্যাত্মিকতায়। বিশ্বাস করতেন সৃষ্টিকর্তায়। তাঁর সৃষ্ট গানগুলোর দিকে তাকালেই আমরা সেটা ভালো করে বুঝি। প্রচুর আধ্যাত্মিকতার ছড়াছড়ি সেগুলোতে। রবীন্দ্রনাথ সবার, সকলের। সাগরের মতো বিশাল এই মানুষটির সৃষ্টি। বিশাল এই সমুদ্রে অবগাহন করে বুঝে উঠতে হয়তো জীবনের পুরো সময়টাই চলে যাবে। তবু ফুরোবে না তাঁর সৃষ্টির মধুত্বের মিষ্টতা।

Leave a Reply