You are currently viewing ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ

বঙ্গীয় নবজাগরণের সূচনালগ্নে বৌদ্ধিক চর্চাকেন্দ্র হিসেবে কলকাতা মহানগরীর উত্থানের আদিপর্বে ১৮০০ সালের ১০ জুলাই কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম চত্বরে প্রতিষ্ঠা পায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিলো ব্রিটিশ আধিকারিকদের ভারতীয় ভাষায় শিক্ষিত করা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলা ও হিন্দির মতো ভারতীয় সকল ভাষার বিকাশ ঘটে।
কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অফ ডিরেক্টর কখনোই কলকাতায় ট্রেনিং কলেজ চালানোর পক্ষে ছিলেন না। কারণ তাদের এই ধরনের কলেজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান ছিলোনা। ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাদের প্রয়োজনের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনের দিকে। ১৮৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ডানা ছেটে দেন। এরপর ১৮৫৪ সালে ডালহৌসি প্রসাশন আনুষ্ঠানিকভাবে এই কলেজ ভেঙ্গে দেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যার পূর্বে অর্থাৎ ১৮০০-১৮৫৪ সাল পর্যন্ত ভারতীয়দের শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতিতে বিশেষ অবদান রেখেছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানে সহস্রাধিক সংস্কৃত,আরবি,ফার্সি,বাংলা,হিন্দি ও উর্দূ বই ইংরেজিতে অনুদিত হয়।

এই কলেজের প্রতিটি বিভাগে ছিলেন সেই যুগের বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যক্তি।এই প্রতিষ্ঠনে যে সকল প্রধান এশিয় ভাষা শিক্ষা দেওয়া হতো সেগুলো হলো আরবি,হিন্দুস্তানি,ফার্সি,সংস্কৃত ও বাংলা। পরবর্তীতে মারাঠি ও চীনা ভাষা শিক্ষা দেওয়াও শুরু হয়। ফার্সি বিভাগের প্রধান ছিলেন সরকারি ফার্সি অনুবাদক নেইল বি. এডমন্ডস্টোন। তার সহকারি শিক্ষক ছিলেন সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারক জন এইচ. হ্যারিংটন ও সেনা কূটনীতিবিদ ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন। আরবি শিক্ষা দিতেন আরবিদি জন বেইলি। হিন্দুস্তানি ভাষা বিভাগটির দায়িত্বে ছিলো বিশিষ্ট ভারত তত্ত্ববিদ জন বোর্থউইক।সংস্কৃত বিভাগের প্রধান ছিলেন প্রাচ্যবিদ এইচ.টি. জন বোর্থউইক গিলক্রিস্টের উপর।দেশীয় ভাষা বিভগের প্রধান ছিলেন একাধিক ভারতীয় ভাষাবিদ ও বেসরকারি মিশনারি উইলিয়ম কেরি।

বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হলেও সে যুগে কলকাতায় বাংলা শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। সেই যুগের ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা শুধু সংস্কৃত পড়াতেন। উইলিয়াম কেরি তখন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকে হেড পন্ডিত,রামমোহন বাচস্পতিকে সেকেন্ড পন্ডিত ও রাম রাম বসুকে অন্যতম সহকারী পন্ডিতের পদে নিয়োগ দেন।মৃত্যুঞ্জয়কে বাংলা গদ্যের ’সচেতন শিল্পী’ মনে করা হয়। কারণ তিনি সংস্কৃতের পন্ডিত হয়েও কলেজের প্রয়োজনে বাংলা লিখতে শুরু করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো –
বত্রিশ সিংহাসন(১৮০২)হিতোপদেশ(১৮০৮),রাজাবলী(১৮০৮)। মৃত্যুঞ্জয় ইংরেঝি জানতেন না। ধারণা করা হয় তিনি কলেজের ইংরেজি জানা পন্ডিতদের থেকে তার বইয়ের উপাদান সংগ্রহ করতেন।

শিক্ষাদানের পাশাপাশি সেই কলেজে অনুবাদ কর্মকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হতো।এই কাজের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ শতাধিক স্থানীয় ভাষাবিদকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেই যুগে বাংলা সাহিত্যের কোনো পাঠ্যপুস্তক পাওয়া যেতো না। ১৭৮৯ সালের ২৩ এপ্রিল “ক্যালকাটা গেজেট” বাংলার অধিবাসিদের নিকট বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান রচনার জন্য একটি বিনীত অনুরোধ প্রকাশ করেন।

শিক্ষাদানের প্রয়োজনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা হয়। এই গ্রন্থাগারে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহিত পুথিপত্র এবং কলেজের নিজস্ব প্রকাশনার বই পত্রও রাখা হয়।পরবর্তীকালে বহু ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বইপত্রও সংরক্ষণ করা হয়। কলেজ ভেঙ্গে দেয়ার সময় এই বিরাট গ্রন্থসংগ্রহ নবগঠিত ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরিকে দান করা হয়। বঙ্গীয় নবজাগরণের যুগে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা এবং ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তার ধ্বংস এ এক বিরল ইতিহাস।

লিখেছেন-

নাহিদা সুলতানা ইলা

শেরপুর সরকারি কলেজ। 


Leave a Reply