You are currently viewing তেল রাজনীতি – নাজমুন নাহার

তেল রাজনীতি – নাজমুন নাহার

১৯৭৩ সালে তেল রপ্তানিকারী আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু শিল্পোন্নত দেশের বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়ায় তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। এর পরিণামে বিশ্ববাজারে তখন তেলের মূল্য বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। যার সুদুরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে।

৫০ এর দশক থেকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেলের দাম নির্ধারণে তাদের অধিকার দাবি করলো। ১৯৬০ সালের দিকে এসে সৌদী আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত এবং ভেনেজুয়েলা গঠন করলো তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট যা বর্তমানে ওপেক নামে পরিচিত। শীঘ্রই এতে যোগ দিল বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ।

১৯৭০-এর দশকের শুরুতে বিশ্বের তেল সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরব রাষ্ট্রগুলো শুরু করলো এক নতুন লড়াই। তারা তেলের দাম বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করার পর আতংক ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে।
সৌদী আরবের তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি তখন জানালেন যে বিশ্ব এক নতুন যুগ শুরু করতে যাচ্ছে। জ্বালানী তেলের যে বাজার মূল্য, তার চেয়ে কম দামে যদি কেউ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে তেল কিনতে চায়, সেটা এখন থেকে আর হবে না। একেবারে পানির দামে জ্বালানি তেল পাওয়ার দিন ফুরিয়ে আসছে। কেননা বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় জুড়ে সেভেন সিস্টার্স বিশ্বের তেলের বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। বিশ্বের ৮৫ শতাংশ তেলের রিজার্ভ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। (1.Anglo-Iranian Oil Company (now BP) 2. Gulf Oil (later part of Chevron) 3. Royal Dutch Shell. 4. Standard Oil Company of California (SoCal, now Chevron) 5. Standard Oil Company of New Jersey (Esso, later Exxon) 6. Standard Oil Company of New York (Socony, later Mobil, now part of ExxonMobil) 7. Texaco (later merged into Chevron) এরাই তেলের দাম ঠিক করতো, এরাই কৃত্রিমভাবে তেলের দাম কমিয়ে রাখতো। তখন ওপেক সিদ্ধান্ত নিল যে তারা তেল শিল্পের জন্য একটা নতুন নীতি অবলম্বন করবে। তারা ঠিক করলো, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোই তেলের দাম নির্ধারণ করবে, সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি তেল কোম্পানি নয়।

১৯৭৩ সালের দিকে ওপেকের চাপের মুখে তেল কোম্পানিগুলোকে অনেক ছাড় দিতে হলো। তখন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ আর জাপানের মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলোর তেলের চাহিদা বাড়ছে বছর বছর। সে বছরই ওপেকের এর বৈঠকে ডক্টর ফাডহিল চালাবি (ইরাকের তেল মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট আন্ডার সেক্রেটারি) তেলের দাম এক লাফে ৭০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তেল কোম্পানি গুলো এই প্রস্তাব শুনে আঁতকে উঠলো।

১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ভিয়েনায় ওপেকের এক তেল মন্ত্রীদের এক বৈঠক ডাকা হলো, সেখানে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হলো মিশর এবং সিরিয়া যুদ্ধ শুরু করলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, যা সব কিছুর মোড় ঘুরিয়ে দিলো। শুরুতে এই যুদ্ধে আরব সেনাবাহিনী বেশ ভালোই করছিল। যখন এই যুদ্ধ চলছে, তখন ভিয়েনায় তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ওপেকের বৈঠকে চলছে অচলাবস্থা। তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে কোন সমঝোতা হলো না। তাই তেল মন্ত্রীরা কুয়েতে আরেকটি বৈঠকে বসলেন। সেখানে ১৯৭৩ সালের ১৬ই অক্টোবর তারা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলেন। এই প্রথম তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেল কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে তেলের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। শুধু তাই নয়, তারা তেলের দাম ৭০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণাও দিল। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকলো না ওপেক। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে তেল সম্পদকে একটি কার্যকর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কথা চলছিল বহুদিন ধরে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বিষয়টা আবার আলোচনায় চলে আসলো। যুদ্ধ শুরুর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র যখন ইসরায়েলে জরুরী সামরিক সাহায্য পাঠাতে শুরু করলো, আরব দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিল, এবার তাদের একটা কিছু করতে হবে। ওপেকের আরব তেল মন্ত্রীরা কুয়েতে থেকে গেলেন, এবং পরদিন ১৭ই অক্টোবর তারা আবার বৈঠকে বসলেন। এই বৈঠকে সৌদী আরবের তেলমন্ত্রী ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোতে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসে, যারা ইসরায়েলে জরুরী ভিত্তিতে সামরিক সাহায্য পাঠিয়েছে। ইরাক অবশ্য তেল নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আরও কঠোর ব্যবস্থার প্রস্তাব দিল। ডক্টর চালাবি জানান, তাদের প্রস্তাব ছিল, সমস্ত আরব দেশে যেসব মার্কিন তেল কোম্পানি আছে, সেগুলো জাতীয়করণ করা।

১৯৭৩ সালের ১৭ ই অক্টোবরের আরেকটি বৈঠক হয়। ডক্টর চালাবি তখন জানালেন যে তেল নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সৌদী আরব এবং কুয়েতের নেতৃত্বে জোরালো সমর্থন দেখা গেল। ইরাক ছাড়া ওপেকের বাকী সব আরব সদস্য যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসে তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে রাজী হলো। দিনে দিনে এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হলো। এর আওতায় তখন পর্তুগাল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও আসলো। এসব কিছুর ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলো ৪ গুন, কোন কোন দেশে তারও বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে তেলের তীব্র সংকট দেখা দিল। পেট্রোল পাম্প গুলোতে তেলের জন্য দীর্ঘ লাইন। তেল রেশনিং করা শুরু হলো। যুক্তরাষ্ট্রে এমনকি ঘন্টায় ৫৫ মাইলের বেশি গতিতে গাড়ী চালানোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। এবারে সত্যি সত্যি পানির দরে তেল কেনার যুগের অবসান ঘটলো। সৌদী আরবের তেল মন্ত্রী শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানি বললেন, ইসরায়েল যদি সব আরব ভূমি থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, তবেই কেবল এই নিষেধাজ্ঞা তোলা হবে, তার আগে নয়। তারপরেই কেবল বিশ্ব ১৭ ই অক্টোবরের আগের দরে তেল পাওয়ার আশা করতে পারে।

বিশ্বে এই প্রথম এক শক্তিশালী জোট হিসেবে আবির্ভূত হলো তেল রপ্তানিকারী আরব দেশগুলো। সৌদি তেল মন্ত্রী শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানি হয়ে উঠলেন তাদের মুখপাত্র। এই তেল নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিল ১৯৭৪ সালের শুরু পর্যন্ত। কিন্তু ওপেক তেলের দাম বাড়িয়েই চললো এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো বিপুল সম্পদশালী হয়ে উঠলো। ডক্টর চালাবি মনে করেন, তেলের এই উচ্চ মূল্য আসলে শেষ পর্যন্ত ওপেকের জন্য ভালো হয়নি। এটা শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থের পক্ষেই গেছে। কারণ তারা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে তেলের নতুন উৎস খুঁজছিল। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও তেল উত্তোলন হচ্ছে। কাজেই তেলের উচ্চমূল্য এখন অনেক টাকা নিয়ে আসছে ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতে এটা বিশ্ববাজারে ওপেকের অংশ কমিয়ে দিতে পারে। তেলের উচ্চমূল্য এখন তাদের এই নতুন প্রকল্পগুলোকে লাভজনক করে তুললো।

Leave a Reply